Friday, October 7, 2016

দ্যি ফিজ, এক তরুণের উঠে আসার গল্প

এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। প্রতিপক্ষ মাগুরা জেলার দল। প্রথম দিনই আগুন ঝরল তাঁর বলে। পেলেন দুই উইকেট। খেলা চলাকালে স্থানীয় কোচ আলতাফ হোসেন ফোন করে মুস্তাফিজের বড় ভাই মোখলেসুর রহমানকে বাগেরহাটে ডেকে নেন। আলতাফ ফোনে বলেন, মুস্তাফিজ দারুণ খেলছে। তাঁকে আসতেই হবে। মাঠে বসে মোখলেসুরও দেখলেন ছোট ভাইয়ের দুর্দান্ত বোলিং। দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি।

মুস্তাফিজের তখন আবদার ছিল একজোড়া নতুন জুতার। মোখলেসুর কথা দিলেন, পরের ম্যাচে তিন উইকেট নিতে পারলে ছোট ভাইটির আবদার পূরণ করা হবে। মুস্তাফিজ তাঁর নিশানা ভেদ করলেন। কুষ্টিয়ার বিরুদ্ধে পরের ম্যাচে ঝোলায় পুরলেন তিন উইকেট। মোখলেসুর পরদিন সানন্দে খুলনা শহর থেকে মুস্তাফিজকে কিনে দেন একজোড়া স্পাইক বুট। মুস্তাফিজের আনন্দ যেন আর ধরে না।

বয়সভিত্তিক এই জেলা পর্যায়ের টুর্নামেন্টটির বাছাই পর্বেই ঘটেছিল বেশ মজার এক ঘটনা। মোখলেসুরের বাইকে চেপে সাতক্ষীরার সরকারি কলেজ মাঠে বোলিংয়ের পরীক্ষা দিতে এসেছেন মুস্তাফিজ। মুস্তাফিজ একা নন, এসেছে আরও অনেক উঠতি তরুণ। আশঙ্কায় খানিকটা কুঁকড়ে গেলেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল, এত প্রার্থীর ভিড়ে পরীক্ষাই বুঝি দিতে পারবেন না। অবশেষে পালা আসে তাঁর। কিন্তু হালকা টেনিস বলে খেলে অভ্যস্ত মুস্তাফিজ কাঠের বল হাতে প্রথমেই ঘটালেন বিপত্তি। প্রথম কয়েকটি বল ঠিকঠাক মতো পিচেই ফেলতে পারলেন না। দৌড়ে এলেন বড় ভাই মোখলেস। খানিকক্ষণ সাহস দিলেন ছোট ভাইকে। তারপর আর আর পিছু ফেরা নয়। একের পর এক দুর্দান্ত বল করে তিনি তাক লাগিয়ে দিলেন নির্বাচকদের। একদম গত ম্যাচটার মতোই। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ওভারেই মাশরাফি বল তুলে দিলেন তাঁর হাতে। আর প্রথম বলেই ওয়াইড। কিন্তু তারপরেই তো হয়ে উঠলেন বিস্ময়! চার ওভারের স্পেলে ডট বলই ষোলটা। অধিনায়ক আফ্রিদির দাবিমতো টি-টোয়েন্টি ‘স্পেশালিস্ট’ দলটির বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্স তো বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না।

কে এই নতুন বিস্ময় ?
বড় ভাই মোখলেসুরের হাত ধরেই প্রথম খেলার মাঠে আসা। পড়াশোনায় অতটা মন তাঁর কখনোই ছিল না। বাসায় তো বলেই দিয়েছিলেন, আমার দ্বারা ওসব হবে না। তোমরা আর জোর করো না। এর পর থেকে ক্রিকেটই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বড়েয়া মিলনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্র্যাকটিস করতেন মুস্তাফিজ। তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন স্থানীয় কোচ আলতাফ। আলতাফই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন মুস্তাফিজের ভেতরের ‘ধারটা’। হিরে চিনে নিয়ে ঘষামাজার কাজটি তিনি শুরু করে দেন। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরও পরিণত করে তুলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরার জেলা কোচ মুফাস্‌সিনুল ইসলাম। এলাকায় অবশ্য ‘তপু ভাই’ বলে পরিচিত তিনি। সকলের পরিশ্রমের প্রতিদান দিতে পেরেছেন মুস্তাফিজ। গত রাতের ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্সই বলছে সে কথা।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার তেঁতুলিয়া গ্রামে মুস্তাফিজদের বাড়ি। বাবা আবুল কাশেম গাজী, মা মাহমুদা খাতুন। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট মুস্তাফিজ। কোনো ডাক নাম নেই তাঁর। বড় ভাই মুখলেস বলেন, ‘নাম ওর একটাই, মুস্তাফিজ।’ ছোট বেলা থেকেই বাঁ-হাতি তিনি। এমনকি প্রথম প্রথম নাকি ভাতও খেতেন বাঁ হাতেই। অনেক চেষ্টায় এই অভ্যাসটি পাল্টানো গেছে তাঁর। ছোটবেলা থেকে বাবা-মা আর বড়দের খুব মেনে চলতেন তিনি। খেলতে নামার আগেও ভোলেননি এই আদব-কায়দা। ফোন করে বাবা-মা, বড় ভাই, স্থানীয় মুরব্বি ও কোচদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবার দোয়া ও আশীর্বাদ নিয়েই খেলতে নামেন তিনি।

তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে সাতক্ষীরা শহরের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। প্রায় প্রতিদিনই এতটা পথ পাড়ি দিয়ে প্র্যাকটিসে যেতেন মুস্তাফিজ। বড় ভাই মোখলেসুর, স্থানীয় কোচ আলতাফ ও জেলা কোচ তপু ভাইয়ের নিয়মিত পরিচর্যায় মুস্তাফিজ শানিয়ে নিতে থাকেন নিজের ধার। যেই ধারের কাছে কচুকাটা হতে থাকে প্রতিপক্ষের একের পর খেলোয়াড়। জেলা পর্যায়ের পর খুব বেশি দিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ডাক পেয়ে যান খুলনার বিভাগীয় দলে খেলার। বছর তিনেক আগে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে এসে কোচরা আর ছাড়েননি এই প্রতিভাকে। নিয়মিতই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। বল করতেন জাতীয় দলের নেটেও। গত বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও আলো ছড়িয়েছিলেন এই পেসার। পেয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নয় উইকেট।

গত বছরের মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও স্থান পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। রীতিমতো চমক ছিলেন তিনি। প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ তখন সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সেরা বোলার সে। হয়তো খুব বেশি ম্যাচ খেলেনি। তবে দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের বাঁ-হাতি পেসারও দরকার।’

মুস্তাফিজ প্রথম শ্রেণিতে খেলা শুরু করেন গত বছর এপ্রিলে। এই তো বছর কানেক আগে অভিষেক হয়েছে ঘরোয়া একদিনের ম্যাচে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খুলনার হয়ে মাত্র আট ম্যাচ খেলেই পেয়েছেন ২৩ উইকেট। গড় ১৮.৯১, ইকোনমিক রেট ২.৬৮। আর লিস্ট এ-তে আবাহনীর পক্ষে ৫ ম্যাচে উইকেট ১২টি। গড় মাত্র ১১.৭৫, ইকোনমিক রেট ৩.৪৫। আন্তর্জাতিক ম্যাচের অভিষেকে তো রীতিমতো কাঁপন ধরিয়ে দিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের। প্রথম ২ ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র ৪ রান। পুরো স্পেল শেষে ২০ রান খরচ করে নিয়েছেন দুইটি উইকেট। সাজঘরে ফিরিয়েছেন শহীদ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ হাফিজের মতো দুজন ব্যাটসম্যানকে। দেশের মাঠিতে পরবর্তী সিরিজে ভারতের খেলোয়াড়দের কিভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে সেটাও দেখিয়েছিলেন ঈর্ষনীয়ভাবে। আইপিলেও নিজের জাত চেনালেন এই বা'হাতি পেসার। বাংলাদেশ দলে বাঁ-হাতি একজন দুর্দান্ত পেসারের ক্ষুধাটা বেশ পুরোনো। অভিষেক ম্যাচের চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স দিয়ে শুরু করেছিলো ‘নতুন দিনের বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন।

এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদার নারীদের অনুপ্রেরণার নাম

সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষ ভ্রমণপিপাসু। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষ জয় করেছে নানা দুর্যোগময় স্থান। শুধুমাত্র নতুনকে দেখার প্রাণান্তকর ইচ্ছা থেকেই এই ধরনের দুর্লভ ভ্রমণগুলো করা সম্ভবপর হয়েছে। পর্বতশৃঙ্গে ভ্রমণের ব্যাপারটি তেমনই একটি ভয়ঙ্কর সুন্দরের হাতছানি দিয়ে ডাকে ভ্রমণপিপাসুদের। যারা জীবনের তোয়াক্কা না করেই এই ভ্রমণের উদ্দেশে নিজেদের উত্সর্গ করে তেমনি একজন ভ্রমণপিয়াসী পর্বতারোহী নিশাত মজুমদার। বিপদকে ভয় নয়, বরং মোকাবিলা করতেই ভালোবাসেন। নেপাল-বাংলাদেশ বন্ধু শিখর অভিযানে সর্বশেষ ২০০ ফুট খাঁড়া দেয়াল বেয়ে ওঠার এক পর্যায়ে এমনভাবে মাঝামাঝি পথে এসে আটকে যান যেন মনে হচ্ছিল এখানেই বুঝি তার অভিযান শেষ। আরও ভয় পেয়ে গেলেন, কারণ যদি পেছনে থাকা নূর মোহাম্মদ ও বিপ্লবদেরও তার কারণে অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। সেই ভয় এখনো তাড়া করে ফেরে ১৯৮১ সালে জন্ম নেওয়া এই পর্বতারোহীকে। বর্তমানে তিনি ঢাকা ওয়াসাতে হিসাব রক্ষণ অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপান স্ট্যাডিজ বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

তার মতে, পাহাড়কে ভালোবাসাই হচ্ছে পর্বতারোহণের মূলমন্ত্র। ২০০৩ থেকে এই মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা নিশাত মৌলিক পর্যায়ের পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নেন ভারতের দার্জিলিং থেকে। এ পর্যন্ত তিনি যাত্রা করেছেন নেপালের মেরা পিক, সিঙ্গুচুলি, মাকালু, ভারতের গঙ্গোত্রী এবং নেপাল বাংলাদেশ বন্ধুত্ব শিখরে। পর্বতারোহণের ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে এমন প্রশ্নের জবাবে নিশাত বলেন, ‘সাধারণত পর্বতারোহী হতে গেলে সবার প্রথমেই যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে হয়, তা হচ্ছে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। কেননা পর্বতারোহণের সময় উচ্চতাজনিত শারীরিক কষ্ট, মাথাব্যথা, বুকব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই এই সমস্যাগুলো মোকাবিলার ক্ষেত্রে নিজেকে প্রথমেই সঠিকভাবে তৈরি করতে হবে। উচ্চতার সাথে শরীরকে খাপ খাওয়াতে হবে এবং ক্লাইম্বিংয়ের প্রতিটি পর্যায়ে সাবধান হতে হবে।’

পর্বতারোহণ মানেই কঠিন এবং ভয়ঙ্কর সুন্দরের হাতছানি। নিশাত এই ট্র্যাকিং আইডিয়াটা পান বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মশহুরুল আমিনের কাছে থেকে। পর্বতারোহণকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ আছে কতটুকু? এমন প্রশ্নের উত্তরে নিশাত বলেন, ‘বাংলাদেশে যেহেতু তেমন কোনো পর্বত নেই, তাই বাংলাদেশে থেকে পর্বতারোহণকে পেশা হিসেবে নেওয়া সম্ভব নয়, তবে বাণিজ্যিকভাবে অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে অন্যান্য দেশে। এখন নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা এই অ্যাডভেঞ্চারে আগ্রহী হচ্ছে কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে গভীরতা বা একাগ্রতা চর্চার প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয়।’ আর পর্বতারোহণকে আমাদের দেশে কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়? উত্তরে নিশাত বলেন, ‘পর্বতারোহণ কোনো বিলাসিতা নয়, বিশ্বকাপ ক্রিকেট বা বিশ্বকাপ ফুটবল বা খো খো খেলা যদি বিলাসিতা না হয়, তবে পর্বতারোহণ কেন বিলাসিতা হবে, এ ক্ষেত্রে কোনো সরকারি আর্থিক সহযোগিতা নেই, এটা খুবই দুঃখজনক। বেসরকারি আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায়, তবে এরজন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা এ ক্ষেত্রে নিবেদিতপ্রাণ, যেমন—মাউন্টেন ডিউ। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে পর্বতারোহণের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে, আরও আছে প্যারাগন গ্রুপ, কসমস গ্রুপ, কাজী ক্রাফট ইত্যাদি।’

পর্বতারোহণে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিশাত বলেন, ‘২০০৯ সালে মাকালু অভিযানে আমাদের দলে থাকা একজন ঝানু পর্বতারোহী ঝুনা ঠাকুর উচ্চতাজনিত অসুস্থতায় মারা যান, তিনি ছিলেন হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট-এর একজন দক্ষ ইন্সস্ট্রাকটর।’ 

‘পর্বতকে অসম্মান করলে পর্বতারোহণে বিপর্যয় অনিবার্য’ ট্র্যাকিংয়ের এই প্রচলিত কুসংস্কার না-মানা নিশাতের কাছে সাফল্যের সংজ্ঞা হচ্ছে একাগ্রতা + পরিশ্রম = সাফল্য। যা পর্বতারোহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত।


- সংগৃহিত।

ইসলামী দর্শনে নারী শিক্ষার গুরুত্ব

সুস্থ পারিবারিক, সামাজিক ও নাগরিক জীবন গঠনের জন্য প্রত্যেক মানুষের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগ্রত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। উপযুক্ত শিক্ষালাভই এ লক্ষ্য অর্জনে প্রথম পদক্ষেপ। তাই পবিত্র ইসলাম ধর্মে শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ আদি মানব হযরত আদম (স.) কে সৃষ্টি করে ধূলির ধরায় তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানোর পূর্বে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিলেন (আল কোরআন-২ : ৩০, ৩১)। ঐশী গ্রন্থ পবিত্র কোরআনের সর্ব প্রথম প্রত্যাদেশ পাঠ কর, তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপি- হতে। পাঠ কর। তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি অতি দানশীল। তিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন; শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না (৯৬ : ১, ২, ৩, ৪, ৫ )। এভাবে বিশ্বপ্রভু মানুষকে সর্বাগ্রে লেখাপড়া শেখার নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) ও তাঁর অনুসারীদের জ্ঞানার্জনের জন্য কঠোর সাধনায় ব্রতী হতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর। তিনি তাঁর আরও অনেক বাণীতে জ্ঞান সাধনার জন্য মানুষ জাতিকে অনুপ্রাণিত করে গেছেন। যেমন মহানবীর ঘোষণা : ১। যে জ্ঞানান্বেষণ করে সে আল্লাহকে অন্বেষণ করে ২। যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণে বহির্গত হয় সে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় থাকে ৩। জ্ঞান চর্চা আল্লাহর কাছে নামাজ, রোজা, হজ ও জেহাদ অপেক্ষা অধিকতর পূণ্যকর কাজ। জ্ঞান সাধকের যথোপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করতে মহানবীর দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা- জ্ঞান সাধকের দোয়াতের কালি শহিদের রক্তের চেয়ে পবিত্র। এভাবে আল্লাহর রসূল উম্মী নবী মুহা¤মদ (স.) জ্ঞান শিক্ষা, চর্চা তথা সাধনার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে গেছেন আজ থেকে ১৪০০ বছরেরও বেশি আগে মরু আরবের বুকে। 

ইসলাম শুধুমাত্র একটি আচার সর্বস্ব ধর্ম নয়। এটি বরং এক সুসংহত ও মহান জীবন বিধান। তাই ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি জাগতিক শিক্ষার উপরও গুরুত্ব আরোপ করেছে ইসলাম। মহানবীর ঘোষণা ছিল, ইহকাল পরকালের শস্যক্ষেত্র। তাই এ শস্য ক্ষেত্রের সদ্ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত জাগতিক জ্ঞান আহরণ অত্যাবশ্যক। আত্মপরিচয় ও অস্তিত্ব রক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম তেমনি উন্নত ও মর্যাদা সম্পন্ন নাগরিক জীবন গঠনের জন্য সাধারণ শিক্ষা ক্ষেত্রেও উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূলের সে মহান বাণী অতিশয় প্রাসঙ্গিক- জ্ঞান অন্বেষণ কর, যদিও তার জন্য সুদূর চীন দেশে যেতে হয়। অর্থাৎ জ্ঞান বিজ্ঞানের উচ্চতর পঠন-পাঠনের জন্য প্রয়োজনে বিদেশ ভ্রমণ করতেও নির্দেশ করে গেছেন বিশ্বনবী (স.)। 

আর যে শিক্ষায় মানুষের কোনও কল্যাণ সাধিত হয় না, যে শিক্ষায় মানুষ পথভ্রষ্ট হয়, সে শিক্ষা ইসলামের শিক্ষা নয়। তাই মহানবী সাবধান- বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, কুলেখক কুকর্মীর তুল্য। শিক্ষিত মানুষের মধ্যে তারা সর্বাপেক্ষা অধম। এভাবে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বাণীতে মানব জাতিকে কল্যাণমুখী শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত জীবন গড়ে তুলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 

ইসলামি জীবন দর্শনে নারী জাতিকে কখনও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। বরং সর্বত্র নারী ও পুরুষের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে। মহাগ্রন্থ কোরআন স্বামী-স্ত্রীকে পরপরের সমতুল্য করে ঘোষণা করে বলেছেন-তোমরা একে অপরের ভূষণ স্ব^রূপ। অধিকন্তু স্ত্রীর সম্মানে মহানবীর বাণী- তোমাদের মধ্যে তারাই সর্বোত্তম যারা তাদের নিজ নিজ স্ত্রীর কাছে সর্বোত্তম। আবার মায়ের মর্যাদা প্রদান করে রাসূল (স.) ঘোষণা করেছেন, তোমাদের বেহেস্ত তোমাদের নিজ নিজ মায়ের পদতলে। নরনারীর পারস্পরিক অবস্থান সম্পর্কে ঐশীগ্রন্থ কোরআনে অনেক বাণী রয়েছে। যেমন- ১) তিনি সৃষ্টি করেছেন যুগল পুরুষ ও নারী খলিত শুক্রবিন্দু থেকে (৫৩ : ৪৫, ৪৬ )। ২) বিশ্বাসী হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে আমি তাকে নিশ্চয়ই আনন্দপূর্ণ জীবন দান করব। আর তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব (১৬ : ৯৭)। ৩) আমি তোমাদের মধ্যে কোন কর্মনিষ্ঠ পুরুষের বা নারীর কর্ম বিফল করি না। তোমরা পরপর সমান (৩ : ১৯৫ )। ৪) পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য আর নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য (৪:৩২)। ৫। বিশ্বাসী নর-নারী একে অপরের বন্ধু (৯:৭১) ৬। আল্লাহ বিশ্বাসী নর ও নারীকে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন (৯ : ৭২)। প

বিত্র কোরআনে বারবার মানুষকে পড়াশোনা করতে, জ্ঞানার্জনে ব্রতী হয়ে আল্লাহর সৃষ্টিকে গভীরভাবে অনুধাবন করতে বলা হয়েছে, কিন্তু কোথাও জ্ঞান শিক্ষার যোগ্যতা এককভাবে পুরুষদের দেয়া হয়নি। আর সে জন্য বিশ্বনবী দ্বিধাহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ (অবশ্য কর্তব্য)। তাঁর অনুসারীরা মূর্খ হোক এমনটা কামনা করেননি আল্লাহর রাসূল। তাই তিনি সাবধান করে বলেছিলেন -মূর্খতা অপেক্ষা বড় দারিদ্র্য আর নেই। জ্ঞানীর নিদ্রা মূর্খের উপাসনা অপেক্ষা উত্তম। 

আমাদের দেশে মাত্র ক’ বছর আগে ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত সকল ছেলে-মেয়েদের জন্য সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। অথচ ১৪০০ বছর আগে আরবের মাটিতে উম্মীনবী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষা গ্রহণকে ফরজ বলে ঘোষণা করেছেন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগের বিদূষী নারীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (স.) কে শিক্ষানুরাগী মহিলারা একবার বললেন, আপনি জ্ঞান শিক্ষা দেয়ার জন্য সব সময় পুরুষদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। তাই আমাদের জন্য একদিন নির্দিষ্ট করলে ভালো হয়। মহানবী তদানুসারে তাদের জন্য শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন, এমনকি তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়েও নারীদের শিক্ষা দিতেন। ফল স্বরূপ অনেক মহিলা প-িতের উদয় হয়েছিল যারা ইসলামের মহান শিক্ষা প্রচারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন- হযরত আয়েশা, উম্মে সালমা, ফাতিমা বিনতে কায়েস, সাফিয়া, সৈয়িদা নাফিসা, উম্মে আদদারদা, আয়শা বিনতে সাদ, জয়নাব বিনতে সালমা, রাসূলের কন্যা ফাতেমা জোহরা, উম্মে আতিয়া, শিমা, সাকিনা, উম্মে সারিক, উম্মেহউসুফ প্রমুখ। ইসলামী দর্শন ছাড়া অন্যান্য বিষয়েও পারদর্শী ছিলেন তখনকার অনেক মহিলা। এমনকি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও মহিলাদের যথেষ্ট অবদান ছিল। খলিফাদের শাসনকালেও নারীরা শিক্ষা-দীক্ষা, সাহিত্য ও কাব্য চর্চা এমনকি সমাজ সেবায়ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। হিজরী পঞ্চম শতাব্দীতে শয়খা শুহদা যিনি ফখরুন্নেসা (নারী কুলের গৌরব) উপাধি পেয়েছিলেন, বাগদাদের কেন্দ্রীয় মসজিদে বিশাল জনসমাবেশে সাহিত্য, অলঙ্কার শাস্ত্র ও কাব্য সম্পর্কে বক্তৃতা করেছিলেন। 

অতএব এটা দিবা লোকের মতো স্পষ্ট যে ইসলামী দর্শন নারী শিক্ষার উৎসাহ দাতা ও পথ প্রদর্শক। ইসলামে নারী শিক্ষার সুযোগ সীমিত-এমন বহুল প্রচারিত ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। মানব জাতির অর্ধাংশ নারী জাতিকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রেখে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। কারণ নারী ও পুরুষ এ মানব সমাজেরই চাকা, তাই এক চাকা দুর্বল হলে তার গতি শ্লথ হতে বাধ্য। নিজেদের অজ্ঞানতা হেতু এ উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ ইসলামের প্রাথমিক যুগের নারীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণের উজ্জ¦ল ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে যায়। তাই এ দেশে নারী শিক্ষা বলতে অর্থ না বুঝে তোতাপাখির মতো কোরআন পাঠই মুসলিম নারীর শিক্ষার মানদ- হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষভাবে অযোগ্য সমাজ কর্তাদের দূরদর্শিতার অভাবে এ দেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামী আর্দশের যথোপযুক্ত মূল্যায়ন হয়নি। ফল স্বরূপ অগণিত মুসলিম মহিলা অজ্ঞানতার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে এক করুণ জীবন-যাপন করছেন এবং সমগ্র সমাজকে পশ্চাৎ দিকে টেনে ধরে রেখেছেন। এরা সমাজের নিকট এমন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন যে এদেরকে সঙ্গে নেয়াও যাচ্ছে না, ফেলে দেয়াও যাচ্ছে না। আধুনিক যুগে মানুষের মেধা ও কর্মক্ষমতাকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অতএব নারীদের উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত রাখা নিঃসন্দেহে মানব সম্পদের অপচয়। 

নারী- পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তার জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা অত্যাবশ্যক। অথচ আল্লাহর দাসীদের জ্ঞানশিক্ষা থেকে বঞ্চিত রেখে যুগ যুগ ধরে অজ্ঞানতার অন্ধকারে রাখা হয়েছে যা এক ধরনের জাতীয় অপরাধ বললে বোধ হয় ভুল হবে না। উপযুক্ত মানুষ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ নারীর ন্যায্য অধিকার, যা ইসলামী পরিভাষায় হক্কল এবাদত- এর পর্যায়ে বিবেচনা করা সমীচীন বলে মনে হয়। সুস্থ মাতৃত্ব, সন্তান পালন, সন্তানের শিক্ষা, পরিবার পরিচালনার জন্য নারীকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতেও শিক্ষার প্রয়োজন অনস্ব^ীকার্য। মুসলিম সমাজেও মহিলা শিক্ষক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, বাস্তুকার, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, প্রযুক্তিবিদ ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা কি অস্বীকার করা যায়? সুতরাং যতদূর সম্ভব ইসলামী জীবন বিধান প্রদত্ত সীমারেখা ও অনুশাসন মেনে নারীর জন্য উপযুক্ত শিক্ষা তথা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কোরআন তফসীর, হাদিস, ফেক্বাহ ইত্যাদি শাখায় তাদের জন্য পঠন-পাঠনের বিশেষ ব্যবস্থা করা একান্ত প্রয়োজন। এমন কি সুস্থ মাতৃত্বের জন্য মেয়েদের পৃথক শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে। 

আমাদের দেশে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে নারীর উপস্থিতি সন্তোষজনক নয়। মুসলিম নারীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষার তেমন কোন উদ্যোগ নেই বললেও চলে। শুধুমাত্র শৈশব তথা বাল্যাবস্থায় মসজিদ মক্তবে সামান্য প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। তাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ও অসংগঠিত। কিন্তু মুসলিম পুরুষদের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে রয়েছে। তাই ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত নারী সমাজ গঠনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক মহিলা মাদ্রাসা স্থাপন একান্ত আবশ্যক। এসব মাদ্রাসায় কারিগরী ও ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। এমনকি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মহিলাদের জন্য ইসলামী শিক্ষার সুযোগ করে দিতে বিশেষ পাঠ্যক্রম চালু করা যেতে পারে। 

অনেকে ভাবেন, পর্দাপ্রথা নারী শিক্ষা, নারী প্রগতির অন্তরায়। কিন্তু ইসলামের পর্দা নারীর মান, সম্মান সম্ভ্রম ও ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। কিন্তু যখন থেকে পর্দার নামে অবরোধ প্রথা চালু করে নারীদের গৃহবন্দী করে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করা হল তখন থেকে মুসলিম জাতির অগ্রগতি ব্যাহত হল এবং কালক্রমে তারা পশ্চাদপদ জাতিতে পরিণত হতে লাগলো। গণমানুষের কবি কাজী নজরুলের ভাষায়-আঁধার হেরেমে বন্দিনী হলো সহসা আলোর মেয়ে সেই দিন হতে ইসলাম গেল গ্লানির কালিতে ছেয়ে। 

পর্দা প্রথার দোহাই দিয়ে মুসলিম নারী সমাজকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করা ইসলামের অনিন্দ্যসুন্দর জীবন বিধানের অবজ্ঞা করা বৈ কিছুই নয়। নারীদের মূর্খ রেখে মুসলমান সম্প্রদায়কে দরিদ্র, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অনগ্রসর তথা অনুন্নত শ্রেণিতে পরিণত করার অধিকার সমাজ কর্তাদের দেয়নি মানবধর্ম ইসলাম। মুসলিম নারী সমাজে কোরআন নির্দেশিত পর্দা প্রথার প্রচলন অত্যাবশ্যক। আধুনিকতার নামে উলঙ্গপনা নয়, পবিত্র কোরআনের শিক্ষার আলোকে শালীনতাপূর্ণ পোশাক পরিধান করে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে যথাযোগ্য অংশগ্রহণ করার মধ্যে রয়েছে মুসলিম নারীর প্রকৃত মুক্তি। দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক সমাজে মুসলিম নারীদেরও চিন্তা-চেতনায় পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। তাই সামাজিক কুসংস্কারকে ঝেড়ে ফেলে মুসলিম নারীরাও আজ স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও পর্দাপণ করছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ শিক্ষার অভাব হেতু আরেক নতুন সংকট সৃষ্টি হতে চলেছে। কারণ আদর্শহীন ও নৈতিকতাবর্জিত শিক্ষিত পুরুষদের মতো শিক্ষিত নারীও সমাজের কাম্য নয়। ষ লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট


সংগ্রহঃ- দৈনিক ইনকিলাব। 

নারী শিক্ষার গুরুত্ব

প্রথমেই শিক্ষা নিয়ে শুরু করা যাক। শিক্ষাকে আমরা বিদ্যা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান অনেক নামেই অভিহিত করতে পারি।দেশ ও সমাজ উন্নয়নের মূল ভিত্তি শিক্ষা৷ সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক নানা কারণে এ দেশের দরিদ্র মানুষ যেমন বঞ্চিত হয়েছে তেমনি সর্বস্তরে ব্যাপক সংখ্যক নারীও এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত৷ পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গেঁাড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যর বেড়াজালে সর্বদা নারীকে ঘিরে রাখা হয়েছে৷ নারী শিক্ষাকে শুধু পরিবারের মঙ্গল, শিশু যত্নের ও ঘরকন্নার কাজে সীমাবদ্ধ রেখে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক জাতীয় উন্নয়নে নিষ্ক্রিয় রাখার পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রবণতা দূর করতে হবে৷ ১ঌ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীও অসামান্য অবদান রেখেছে৷ সস্বাধীনতার পর থেকে নারী আত্মনির্ভরশীল, জাতীয় উত্‌পাদনে অংশগ্রহণ, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন হয়ে ওঠে৷ তাই নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং সেই আলোকে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷

নারী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারীকে সচেতন ও প্রত্যয়ী করা, সম-অধিকারের অনুকূলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গী প্রখর করা, সকল পর্যায়ে দেশ পরিচালনায় অংশ গ্রহণে নারীকে উদ্বৃদ্ধ ও দক্ষ করা, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও দারিদ্র বিমোচনে নারীর অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে সহায়তা করা, সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ্যময় পরিবার গঠনে উত্‌সাহিত করা এবং যৌতুৃক ও নারী নির্যাতন রোধ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে পারেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মপ্রত্যয় নারীর মধ্যে সৃষ্টি করা৷

বর্তমানে নারী শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের নামে অনেক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে পাশ্চাত্যের অনুকরণে। কত নীতিমালা রচিত হচ্ছে ও হবে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও নারী উন্নয়ন নীতি মালার নামে একটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছিল, কিন্তু দেশের ধর্মপ্রিয় মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে তারা ক্ষান্ত হয়। ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি মাঝে মাঝে শয়তানের খপ্পরে পড়ে শাসক শ্রেণী তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। নীতিমালার একটা ধারা হল : জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ১৫ পৃষ্ঠার ৯-১৩ উপ-ধারায় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, "নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যথা-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবন-ব্যাপী শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা, তথ্য, উপার্জনের সুযোগ, সম্পদ, ঋণ, প্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সেই লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়ন করা।" যেহেতু এখানে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, তাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার জন্য তো শুধু নারীকে আলাদা গুরুত্ব দেব কেন? সংবিধানই তো বলে সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে। এভাবে আইন প্রণয়ন না করে সবার জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করলেই সুন্দর ব্যবস্থা যায়। কুচক্রীদের কুমতলব আছে, তারা ধর্মীয় ভাবসদ্ভাবে আঘাত করে ধর্মীয় উম্মাদনা তৈরী করতে চায়। যাতে ইসলামকে একটি বিশৃংখল ধর্ম বলে প্রচারণা চালাতে পারে। আমাদের নীতি নির্ধারকদের মনে রাখা উচিত, দেশের জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধকেই শিক্ষানীতি তৈরী করার সময় প্রাধান্য দিতে হবে। নৈতিকতাহীন শিক্ষা, পরস্পর বিরোধী শিক্ষা, সহশিক্ষা, সেশনজট মুক্ত শিক্ষা পরিহার করে একটি জীবন ও জগতের পরিচ্ছন্ন ধারণানুযায়ী উৎপাদনশীল ও কর্মমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যা প্রযোজ্য হতে পারে।

এটা অবধারিত সত্য যে, শিক্ষাক্ষেত্রের নারীর কাক্মিখত অগ্রগতি না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনই সম্ভব হবে না। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে সকল স্তরের শিক্ষায় জেন্ডার বৈষম্য হ্রাস করার কথাও বলা হয়েছে।

নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপের জন্য আন্তর্জাতিক দলিল সিডো সনদে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নারীর শিক্ষা অর্জনের সমাধিকারের প্রতি। সিডো সনদের ধারা ১০-এ শিক্ষাক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীর শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য খাদ্য কর্মসূচি রয়েছে। পৌরসভার বাইরে বিনাবেতনে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ আর মহানগরের বাইরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তির সুযোগ রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে।

শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে জাতীয় নারী প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমি পুনর্গঠন এবং প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপন করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, বেগম শহীদ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি এবং মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। বয়স্ক নারী শিক্ষা কার্যক্রমও চালু করা হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে আরও অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

নারী শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে বেসরকারি পর্যায়েও রয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। রয়েছে মেয়েদের জন্য বিভিন্ন সংস্থার বিশেষ বৃত্তি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, আয়মূলক প্রশিক্ষণের সঙ্গে শিক্ষ, নারীদের জন্য বিশেষ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন উদ্যোগে।

সন্দেহ নেই, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নারী শিক্ষার হার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তারপরও আর্থ-সামাজিক বেশকিছু সমস্যা রয়েগেছে যা নারী শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

নারীর উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আর্থ-সামাজিক বাঁধাগুলো দূর করা প্রয়োজন। সর্বোপরি সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য নারীর উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প কোন পথ নেই।



- সংগৃহিত।