Wednesday, October 5, 2016

মাদার তেরেসা: এক মহিয়সী নারীর নাম

“The poor must know that we love them” মাদার তেরেসা এ’কথা বলতেন, বিশ্বাস করতেন এবং আজীবন চর্চা করেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি ব্যয় করেছেন আর্তমানবতার সেবায়। মিশনারিতে ব্রত নেয়ার আগে মাদার তেরেসার নাম ছিল গনদোহা । তুর্কি এ শব্দটির অর্থ “ ফুটন্ত ফুল ” । ঠিক ফুটন্ত ফুলের মতোই তিনি সৌরভ ছড়িয়ে ছিলেন নিপীড়িত, নির্যাতিত, দরিদ্র মানুষের মাঝে । মাদার তেরেসা ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার স্কপিয়তে জম্মগ্রহণ করেন। সাবেক যুগোশ্লাভিয়ার বাসিন্দা হলেও তাঁরা ছিলেন আলবেনিয়ার নাগরিক। তাঁর পিতার নাম ছিল নিকোলাস বয়াক্সহিউ । তিনি ছিলেন আলবেনীয় ব্যবসায়ী। মায়ের নাম ছিল ড্রানফিল বার্নাই। পারিবারিক পদবী অনুসারে তার নাম রাখা হয় অ্যাগনেস বয়াক্সহিউ। তিন ভাইবোনের মধ্যে অ্যাগনেস ছিল সবার ছোট । ২৬ অগস্ট অটোম্যান সাম্রাজ্যের ইউস্কুবে (অধুনা ম্যাসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের রাজধানী স্কোপিয়) জন্মগ্রহণ করেন। তবে ২৬ আগস্ট জন্ম হলেও তিনি ২৭ আগস্ট তারিখটিকে তাঁর "প্রকৃত জন্মদিন" মনে করতেন; কারণ ওই তারিখেই তাঁর ব্যাপটিজম সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি ছিলেন নিকোলো ও দ্রানা বয়াজুর কনিষ্ঠ সন্তান। তাঁদের আদি বাসস্থান ছিল আলবেনিয়ার শকড্যর্  অঞ্চলে। তাঁর পিতা আলবেনিয়ার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৯ সালে মাত্র আট বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মা তাঁকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। জোয়ান গ্র্যাফ কুকাস রচিত জীবনী থেকে জানা যায়, ছোট্টো অ্যাগনেস মিশনারিদের জীবন ও কাজকর্মের গল্প শুনতে ভালবাসতেন। ১২ বছর বয়সেই তিনি ধর্মীয় জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে একজন মিশনারি হিসেবে যোগ দেন সিস্টার্স অফ লরেটো সংস্থায়। মা আর দিদিদের সঙ্গে আর তাঁর কোনোদিন দেখা হয়নি।

অ্যাগনেস প্রথমে আয়ারল্যান্ডের রথফার্নহ্যামে লোরেটো অ্যাবেতে ইংরেজি ভাষা শিা করতে যান। কারণ এই ভাষাই ছিল ভারতে সিস্টার্স অফ লরেটোর শিার মাধ্যম। ১৯২৯ সালে ভারতে এসে দার্জিলিঙে নবদীতি হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে তিনি সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন। তরুণী গনদোহা তাঁর ১৮তম জন্মদিনে মিশনারি জীবন বেছে নেয়ার শপথ নিয়েছিলেন। তিনি যখন সন্ন্যাসীতে ব্রতী হন তখন একজন ফরাসি সন্ন্যাসী তেরেসা মার্টিনের নাম অনুযায়ী তাঁর নাম রাখা হয় মাদার তেরেসা।

মাদার তেরেসার জন্মের সময়টা ছিল ইউরোপের এক দুঃসময়ের কাল । তাঁর জন্মের বছরই ঘটে গেল আলবেনিয়ায় বিদ্রোহ ।  এর ঠিক দু’বছর পর বলকান রাষ্ট্রগুলোও জড়িয়ে গেল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে । আরো দু’বছর পর ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ । এই চরম অস্থিরতার সময়ও মাদার তেরেসার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিল। মাদার তেরেসার বয়স যখন ৮ তখন তাঁর পিতা নিকোলাস মারা যান। এ সময় সন্তানদের মঙ্গল কামনায় সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরলেন তাঁর মাতা ড্রানাফিল।

অদম্য সাহসের সঙ্গে তিনি গড়ে তোলেন নিজের এমব্রয়ডারীর ব্যবসা । এ সময় স্কপিয়ের তৈরি কার্পেটের খ্যাতি ছিল বিশ্বময় । ড্রানাফিল কার্পেট ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। ব্যবসায় যেমন সাফস্য আসতে লাগল তেমনি পুরো পরিবারটি নিবেদিত হলো ধর্মীয় কর্মকান্ডে ।  ছেলেমেয়েরা স্থানীয় চার্চের স্কুলে যেত । চার্চে শিশুরা ড্রানাকে ডাকত ‘নানা লোকে’ অর্থাৎ আত্মার জননী বলে , তেমনি অ্যাগনেসকে ডাকত গনদোহা বা ‘ফুটন্ত ফুল’ বলে।  মাদার তেরেসা ও তার বোন আগা দু’বোন ভর্তি হলো স্কপিয়ের মাধ্যমিক স্কুলে।  ১৯২৪ সালে তিনি যোগ দেন অস্ট্রেলিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ।  তার পরের বছরই সোসাইটি অব জিসাসের পাদরি হয়ে এলেন ফাদার জ্যামব্রেনকোইচ এবং তিনি অ্যাগনেসকে গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করলেন ‘নান’ হওয়ার । ১৯২৮ সালে তিনি রোমান ক্যাথলিক নান হিসেবে আয়ারল্যান্ডের এক গির্জায় দায়িত্ব পালন করতে যান। এখানে আয়ারল্যান্ডের রথফার্নহ্যামে লোরেটো অ্যাবেতে ইংরেজি ভাষা শিা করেন। কারণ এই ভাষাই ছিল ভারতে সিস্টার্স অফ লোরেটোর শিার মাধ্যম।  ফাদার জ্যামব্রেনকোইচ নবীন নানদের জন্য একটি শাখা খোলেন এবং অ্যাগনেস এ দলে যোগ দেন, যা তাঁর হৃদয়কে ঈশ্বরের চিন্তায় পরিপূর্ণ করে তোলে। ফাদার অবশ্য বেশি আগ্রহী ছিলেন অ্যাগনেসকে জেসুইট সম্প্রদায়ের মিশনারি কাজে, বিশেষ করে তাঁদের দারিদ্র আর কুষ্ঠরোগীদের সেবা করার ব্যাপারে ।  ঠিক ওই সময়ে তিনি যুগোশ্লাভিয়া থেকে ভারতে যাওয়া কয়েকজন মিশনারির কাছ থেকে সেখানকার দারিদ্রপীড়িত, অনাহারকিষ্ট মানুষের কথা জেনেছিলেন। মঠবাসিনী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ১৯২৮ সালে তিনি ডাবলিনে কনভেন্টে যোগ দিয়েছিলেন।  সেখানেই তাঁর নাম হয় ‘সিস্টার তেরেসা ’ ।

ভারতে যাওয়া মিশনারিদের কাছ থেকে কলকাতার লরেটো ইনস্টিটিউটের নাম শুনেছিলেন তিনি। লরেটো হচ্ছে এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যা ভারতের মিশনারি স্কুলগুলো পরিচালনা করে । অ্যাগনেস পশ্চিম বাংলার রাজধানী কলকাতার আশপাশের দারিদ্র পীড়িত মানুসের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন যে, ভারতে তার মিশন যেন সফল হয় ।  তিনি এ মিশনারি কাজে এতই আগ্রহী হন যে , তিনি তাঁর সম্পর্কিত বোনের কাছে কানের দুল চেয়ে নিয়ে দান করতেন ভারতের মিশনারিদের তহবিলে। দু’বছর ধরে নিজে তার মনের সাথে বোঝাপড়া করলেন এবং অবশেষে তিনি সিদ্ধান্তÍ নিলেন মিশনারি হওয়ার এবং তা ভারতেই । যখন তিনি তাঁর এ ইচ্ছা তাঁর মায়ের কাছে প্রকাশ করলেন তখন তাঁর মা নিজেকে ২৪ ঘন্টা বন্ধ করে রাখলেন প্রার্থনায় । শেষে তিনি মত দিলেন । তিনি বললেন, ‘তোমার হাত ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ কর এবং সারাজীবন তাঁর পথে চল’। তাঁর মায়ের এ উপদেশ সারাজীবনের জন্য তিনি ভোলেননি । অবশেষে মাদার তেরেসা লরেটো নানদের শ্রেণীভুক্ত হওয়ার আবেদন করলেন বাংলায় মিশনারি কাজ করার জন্য। তাঁর আবেদন গৃহীত হয় ১৯২৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর। মিশনারি কাজ করার জন্য কলকাতা পৌঁছালেন। প্রথমে তিনি দু’সপ্তাহ ইংরেজী শিখলেন তারপর দার্জিলিং এ মিশনারি প্রশিক্ষণ শেষ করলেন। ১৯২৯ সালের ৬ জানুয়ারি স্বল্প সময়ের জন্য তিনি আবার কলকাতায় এলেন। ১৯৩৭ সালের ১৪ মে পূর্ব কলকাতায় একটি লরেটো কনভেন্ট স্কুলে পড়ানোর সময় তিনি সন্যাসিনী হিসেবে চূড়ান্ত শপথ নেন। এর আগে তিনি প্রথম শপথ নেন ১৯৩১ সালের ২৪ মে।

আবার তিনি বেরিয়ে পড়লেন ৪শ’৫০ মাইল দূরে তাঁর কর্মস্থল দার্জিলিং এ। তারপর পরবর্তী কয়েক বছর তিনি দার্জিলিং এ সময় কাটালেন লরেটো কনভেন্টে প্রার্থনা, শিক্ষকতা এবং প্রশিক্ষণে। ভারতে আসার আড়াই বছর পর ১৯৩১ সালের ২৮ মে মাদার দক্ষিণা গ্রহণ করেন সিস্টার অব লরেটো হিসেবে। তিনি তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাঁর প্যাট্রন সেইন্ট টেরেসা অব লিসিউ বা শিশু যিশুর সেইন্ট টেরেসের নাম নেয়ার। কিন্তু এতে বিপত্তি দেখা দিল, কারণ অন্য একজন নানও নিজেকে এ নামে অভিহিত করতে চাইলেন। তখন মাদার সেইন্ট টেরেসের স্পেনীয় বানান গ্রহণ করে রূপান্তরিত হলেন সিস্টার তেরেসাতে।

১৯৩৭ সালের ১৪ মে তিনি দীক্ষা গ্রহণ করলেন দারিদ্র্য, সতীত্ব আর আনুগত্যের। তখন তাঁকে দার্জিলিং থেকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠান হলো কলকাতায়। কলকাতায় লরেটো নানদের বেশ বড় রকমের সম্পত্তি রয়েছে সেইন্ট মেরিজ নামে। সেখানে ৫ শতাধিক অনাথ মেয়েদের জন্য রয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থা। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ছিল খ্রিস্টানদের সকল শাখার একটি অনাথ আশ্রম বিশেষ। উঁচু প্রাচীর ঘেরা বাড়িটিতে মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েদের জন্য একটি ছোট স্কুল ছিল। স্কপিয়তে থাকাকালীন তিনি যে মানবকল্যাণে শিক্ষা লাভ করেছিলেন, সেইন্ট মেরিজের কাছে তিনি সেই সাদৃশ্য খুঁজে পেলেন। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি দরিদ্র, অসুস্থ, অনাথ ও মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের সেবা করেছেন। সেই সঙ্গে মিশনারিজ অব চ্যারিটির বিকাশ ও উন্নয়নেও অকান্ত পরিশ্রম করেছেন। প্রথমে ভারতে ও পরে সমগ্র বিশ্বে তাঁর এই মিশনারি কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর মৃত্যুর পর পোপ দ্বিতীয় জন পল তাঁকে স্বর্গীয় আখ্যা দেন এবং তিনি কলকাতার ‘ স্বর্গীয় তেরেসা ’ নামে পরিচিত হন।

মিশনারী অব চ্যারিটি শাখার সদস্যরা বস্তিবাসীদের নিরঙ্কুশ দারিদ্র্য মোচনের চেষ্টা করতো। প্রতি শনিবার তাঁর নেতৃত্বে কিছু মেয়ে যেত বস্তি পরিদর্শনে। আর কিছু যেত নীলরতন সরকারি হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের শুশ্রƒষা ও সান্তনা দিতে। স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য বাংলা শেখেন সিস্টার তেরেসা। একই সঙ্গে তিনি হিন্দিতেও পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি স্কুলে পড়াতেন ভূগোল ও ইতিহাস। এক সময় সিস্টার জীবন ছেড়ে চলে গেলেন কনভেন্টের বাইরে। কনভেন্টের বাইরে থেকেই তার চোখে পড়ত দারিদ্র্যের দৃশ্য। ১৯৪৩ এর মন্বন্তরে মারা যায় প্রায় বিশ লাখ মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হলো কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অচল হয়ে গেল সারা শহর। পরবর্তীকালে মাদার তেরেসা বর্ণনা করেছেন-‘শহরের রাস্তায় ছুরিকাহত ক্ষতবিক্ষত নিহত মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি নিজের চোখে’। দেশ বিভাগের ফলে লাখ লাখ হিন্দু-মুসলিম আর শিখ দেশ বদল করেছে চরম দূরাবস্থার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের লাহোর, ঢাকা, করাচি, চট্টগ্রামের মতো কলকাতা হয়ে দাঁড়াল অসংখ্য বাস্তহারা মানুষের ভীড়ে ভারাক্রান্ত।  স্কুলে পড়াতে তাঁর ভাল লাগলেও কলকাতার দারিদ্র্যে তিনি উত্তরোত্তর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে লাগলেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরে শহরে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ আর মৃত্যু। ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাতেও বহু মানুষ মারা যান। এই সব ঘটনা তেরেসার মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

১৯৪৬ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর ধর্মীয় নির্জনবাসের জন্য দার্জিলিং যাওয়ার সময় তাঁর মধ্যে এক গভীর উপলব্ধি আসে। এই অভিজ্ঞতাকে পরবর্তীতে "the call within the call"  হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ নিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন, “কনভেন্ট ত্যাগ করে দরিদ্রদের মাঝে বাস করা এবং তাদের সহায়তা করা আমার জন্য আবশ্যক ছিল। এটা ছিল এক সরাসরি আদেশ। এই আদেশ পালনে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ ছিল বিশ্বাস ভেঙে ফেলা”।

১৯৪৮ সালে এই মোতাবেক তিনি দরিদ্রের মাঝে মিশনারি কাজ শুরু করেন। প্রথাগত লরেটো অভ্যাস ত্যাগ করেন। পোশাক হিসেবে পরিধান করেন নীল পাড়ের একটি সাধারণ সাদা সুতির বস্ত্র। এ সময়ই ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করে বস্তি এলাকায় কাজ শুরু করেন। প্রথমে একটি ছোট স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ক্ষুধার্ত ও নিঃস্বদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করেন। তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে থাকেন। তার এই কার্যক্রম অচিরেই ভারতীয় কর্মকর্তাদের নজরে আসে। তদানীন্তন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাঁর কাজের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

প্রথম দিকের এই দিনগুলো তার জন্য বেশ কষ্টকর ছিল। এ নিয়ে ডায়েরিতে অনেক কিছুই লিখেছেন। সে সময় তাঁর হাতে কোন অর্থ ছিল না। গরীব এবং অনাহারীদের খাবার ও আবাসনের অর্থ জোগাড়ের জন্য তাঁকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হতো। ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হতো। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময়ই হতাশা, সন্দেহ ও একাকিত্ব বোধ করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, কনভেন্টের শান্তির জীবনে ফিরে গেলেই বোধহয় ভাল হবে। ডায়েরিতে লিখেছিলেন: '' Our Lord wants me to be a free nun covered with the poverty of the cross. Today I learned a good lesson. The poverty of the poor must be so hard for them. While looking for a home I walked and walked till my arms and legs ached. I thought how much they must ache in body and soul, looking for a home, food and health. Then the comfort of Loreto [her former order] came to tempt me. 'You have only to say the word and all that will be yours again,' the Tempter kept on saying … Of free choice, my God, and out of love for you, I desire to remain and do whatever be your Holy will in my regard. I did not let a single tear come. ''

১৯৫০ সালের ৭ই অক্টোবর তেরেসা "ডায়োসিসান কনগ্রেগেশন" (বিশপের এলাকার মত সমাবেশ) করার জন্য ভ্যাটিকানের অনুমতি লাভ করেন। এ সমাবেশই পরবর্তীতে মিশনারিস অব চ্যারিটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য তেরেসার নিজের ভাষায় বললেই ভাল শোনাবে: '' Its mission is to care for the hungry, the naked, the homeless, the crippled, the blind, the lepers, all those people who feel unwanted, unloved, uncared for throughout society, people that have become a burden to the society and are shunned by everyone. ''     

কলকাতায় মাত্র ১৩ জন সদস্যের ছোট্ট অর্ডার হিসেবে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এর অধীনে ৪ হাজারের  এরও বেশি নান কাজ করছেন। চ্যারিটির অধীনে এতিমখানা ও এইড্স আক্রান্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালিত হয়। বিশ্বব্যাপী শরণার্থী, অন্ধ, পাঘাতগ্রস্ত , বয়স্ক, মাদকাসক্ত, দরিদ্র, বসতিহীন এবং বন্যা, দুর্ভিক্ষ বা মহামারিতে আক্রান্ত মানুষের সেবায় চ্যারিটির সবাই এখনও অকান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

১৯৫২ সালে মাদার তেরেসা কলকাতা নগর কর্তৃপরে দেয়া জমিতে মুমূর্ষুদের জন্য প্রথম আশ্রয় ও সেবা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সহায়তায় একটি পরিত্যক্ত হিন্দু মন্দিরকে কালিঘাট হোম ফর দ্য ডাইং-এ রূপান্তরিত করেন। এটি ছিল দরিদ্রদের জন্য নির্মীত দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র। পরবর্তীতে এই কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘ নির্মল হৃদয় ’। এই কেন্দ্রে যারা আশ্রয়ের জন্য আসতেন তাদেরকে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া হতো এবং সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণের সুযোগ করে দেয়া হয়। মুসলিমদেরকে কুরআন পড়তে দেয়া হয়, হিন্দুদের গঙ্গার জলের সুবিধা দেয়া হয় আর ক্যাথলিকদের প্রদান করা হয় লাস্ট রাইটের সুবিধা। এ বিষয়ে তেরেসা বলেন,"A beautiful death is for people who lived like animals to die like angels — loved and wanted." এর কিছুদিনের মধ্যেই তেরেসা হ্যানসেন রোগে (সাধারণ্যে কুষ্ঠরোগ নামে পরিচিত) আক্রান্তদের জন্য একটি সেবা কেন্দ্র খোলেন যার নাম দেয়া হয় ‘ শান্তি নগর ’। এছাড়া মিশনারিজ অব চ্যারিটির উদ্যোগে কলকাতার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ কিছু কুষ্ঠরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই কেন্দ্রগুলোতে ওষুধ, ব্যান্ডেজ ও খাদ্য সুবিধা দেয়া হয়। মিশনারি শিশুদের লালন-পালন করতো। এক সময় শিশুর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় তেরেসা তাদের জন্য একটি আলাদা হোম তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এই অনুভূতি থেকেই ১৯৫৫ সালে ‘ নির্মল শিশু ভবন ’ স্থাপন করেন। এই ভবন ছিল এতিম ও বসতিহীন শিশুদের জন্য এক ধরণের স্বর্গ।

অচিরেই মিশনারিস অব চ্যারিটি দেশ-বিদেশের বহু দাতা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়। এর ফলে অনেক অর্থ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। ১৯৬০-এর দশকের মধ্যে ভারতের সর্বত্র চ্যারিটির অর্থায়ন ও পরিচালনায় প্রচুর দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র, এতিমখানা ও আশ্রয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের বাইরে এর প্রথম কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায়। মাত্র ৫ জন সিস্টারকে নিয়ে সে কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া এবং অস্ট্রিয়াতে শাখা খোলা হয়। ১৯৭০-এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েক ডজন দেশে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সাথে অবশ্য তাঁর দর্শন ও প্রায়োগিক দিক নিয়ে কিছু সমালোচনাও হয়। মাদার তেরেসার বিরুদ্ধে সমালোচকরা খুব কম তথ্যই হাজির করতে পেরেছিলেন। একথা স্বীকার করে নিয়েই ডেভিড স্কট বলেন, “মাদার তেরেসা স্বয়ং দারিদ্র্য বিমোচনের বদলে ব্যক্তি মানুষকে জীবিত রাখার উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।” এছাড়া কষ্টভোগ বিষয়ে তাঁর মনোভাবও সমালোচিত হয়েছে। অ্যালবার্টার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “তিনি মনে করতেন, কষ্টভোগের মাধ্যমে যীশুর কাছাকাছি যাওয়া যায়।” এছাড়া ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ও দ্য ল্যান্সেট পত্রিকায় তাঁর সেবা কেন্দ্রগুলোর চিকিৎসা সেবার মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকেই এক হাইপোডার্মিক সূচ একাধিক বার ব্যবহারের কথা বলেছেন। কেন্দ্রগুলোর জীবনযাত্রার নিম্নমানও সমালোচিত হয়েছে। তার উপর চ্যারিটির অ-বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পদ্ধতিগত রোগ-নিরূপণকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল। ১৯৭০-এর দশকের মধ্যেই সমাজসেবী এবং অনাথ ও আতুরজনের বন্ধু হিসেবে তাঁর খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ম্যালকম মাগারিজের বই ও প্রামাণ্য তথ্যচিত্র সামথিং বিউটিফুল ফর গড তাঁর সেবাকার্যের প্রচারের েেত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ১৯৭৯ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি তাঁর সেবাকার্যের জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার ও ১৯৮০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন লাভ করেন। মাদার তেরেসার মৃত্যুর সময় বিশ্বের ১শ’২৩টি রাষ্ট্রে এইচআইভি/এইডস, কুষ্ঠ ও যার চিকিৎসাকেন্দ্র, ভোজনশালা, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম ও বিদ্যালয়সহ মিশনারিজ অব চ্যারিটির ৬শ’১০টি কেন্দ্র বিদ্যমান ছিল। পরে বিভিন্ন কারণে এর সংখ্যা হ্রাস পায়।

বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা ও একাধিক রাষ্ট্রের সরকার তাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু কোনো কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার সমালোচনার মুখেও তাঁকে পড়তে হয়। ক্রিস্টোফার হিচেন্স, মাইকেল প্যারেন্টি, অরূপ চট্টোপাধ্যায়, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ প্রভৃতি ব্যক্তি ও সংস্থা জন্মনিরোধক এবং গর্ভপাতের বিষয়ে তাঁর আপত্তি, দারিদ্র্যের আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্যে তাঁর বিশ্বাস ও মৃত্যুপথযাত্রীদের খ্রিষ্টধর্মে দীতি করার সমালোচনা করেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসার নিম্নমানের সমালোচনা করা হয় এবং দানের অর্থের অস্বচ্ছ ব্যয়ের বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।

১৯৮২ সালে বৈরুত অবরোধের চূড়ান্ত  প্রতিকূল সময়ে মাদার তেরেসা যুদ্ধের একেবারে ফ্রন্ট লাইনের হাসপাতালে আটকে পড়া ৩৭ শিশুকে উদ্ধার করেন। ইতোমধ্যে ইসরায়েলী সেনাবাহিনী ও ফিলিস্তিনী গেরিলাদের মধ্যে সাময়িক যুদ্ধ বিরতি ঘটায় পরিবেশ কিছুটা অনুকূলে এসেছিলো। এই সুযোগেই রেডক্রসের সহায়তায় তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে যান। বিধ্বস্ত হাসপাতালগুলো থেকে কম বয়সের রোগীদের সরিয়ে আনেন।

সমাজতান্ত্রিক শাসনের সময়ে পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশেই মিশনারি কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৮০-'র দশকে ইউরোপের সে অংশ তুলনামূলক উদার হয়ে উঠে। এ সময়েই মাদার তেরেসা মিশনারিস অব চ্যারিটির কাজ পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে সম হন। কয়েক ডজন প্রকল্পের মাধ্যমে তার কাজ শুরু হয়েছিল। এ সময় গর্ভপাত এবং বিবাহবিচ্ছেদ-এর বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের কারণে অনেকে তার সমালোচনা করেন। কিন্তু তেরেসা সব সময় বলতেন, "No matter who says what, you should accept it with a smile and do your own work."

মাদার তেরেসা ইথিওপিয়ার ুধার্তদের কাছে যেতেন, ভ্রমণ করতেন চেরনোবিল বিকিরণে আক্রান্ত অঞ্চলে। আমেরিকার ভূমিকম্পে আক্রান্তদের মাঝে সেবা পৌঁছে দিতেন। ১৯৯১ সালে মাদার তেরেসা প্রথমবারের মত মাতৃভূমি তথা আলবেনিয়াতে ফিরে আসেন। এদেশের তিরানা শহরে একটি "মিশনারিস অব চ্যারিটি ব্রাদার্স হোম" স্থাপন করেন।

তিনি ১৯৯৬ সালে পৃথিবীর ১শ’ টিরও বেশি দেশে মোট ৫শ’১৭টি মিশন পরিচালনা করতেন। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছে। তারা সবাই বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪শ’৫০টি কেন্দ্রে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছিল। গরিবদের মধ্যেও যারা গরিব তাদের মাঝে কাজ করতো এই চ্যারিটি, এখনও করে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চ্যারিটির প্রথম শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় নিউইয়র্কের  ব্রঙ্ক্স বরোর দণিাঞ্চলে। ১৯৮৪ সালের মাঝে যুক্তরাষ্ট্রে চ্যারিটির প্রায় ১৯টি শাখা সক্রিয় ভাবে কাজ করা শুরু করে। চ্যারিটি দাতব্য কাজের জন্য যে অর্থ পেতো তার ব্যবহার নিয়ে বেশ কয়েকজন সমালোচনা করেছেন। ক্রিস্টোফার হিচেন্স ও স্টার্ন সাময়িকী সমালোচনা করে বলেছে, গরীবদের উন্নয়নের কাজে চ্যারিটিতে যত অর্থ আসে তার কিছু অংশ অন্যান্য কাজেও ব্যয় করা হয়।

১৯৮৩ সালে পোপ জন পল ২ এর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে রোম সফরের সময় মাদার তেরেসার প্রথম হার্ট এ্যাটাক হয়। ১৯৮৯ সালে আবার হার্ট এ্যাটাক হওয়ার পর তাঁর দেহে কৃত্রিম পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ১৯৯১ সালে মেক্সিকোতে থাকার সময় নিউমোনিয়া হওয়ায় হৃদরোগের আরও অবনতি ঘটে। এই পরিস্থিতিতে তিনি মিশনারিজ অফ চ্যারিটির প্রধানের পদ ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব করেন। কিন্তু চ্যারিটির নানরা গোপন ভোট গ্রহণের পর তেরেসাকে প্রধান থাকার অনুরোধ করে। অগত্যা তেরেসা চ্যারিটির প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে পড়ে গিয়ে কলার বোন ভেঙে ফেলেন। আগস্টে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। এর পাশাপাশি তাঁর বাম হৃৎপিন্ডের নিলয় রক্ত পরিবহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ মার্চ মিশনারিজ অব চ্যারিটির প্রধানের পদ থেকে তেরেসা সরে দাঁড়ান। ৫ সেপ্টেম্বর এই মহিয়সী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কলকাতার আর্চবিশপ হেনরি সেবাস্তিয়ান ডি'সুজা বলেন, তেরেসা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তিনি এক ধর্মপ্রচারককে এক্জোর্সিজ্ম করতে বলেছিলেন। কারণ, তার ধারণা ছিল, কোন শয়তান তেরেসাকে আক্রমণ করেছে। মৃত্যুর সময় মাদার তেরেসার মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে সিস্টারের সংখ্যা ছিল ৪ হাজার, এর সাথে ৩শ’ জন ব্রাদারহুড সদস্য ছিল। আর স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ছিল এক লাখের উপর। পৃথিবীর ১শ’২৩টি দেশে মোট ৬শ’১০টি মিশনের মাধ্যমে চ্যারিটির কাজ পরিচালিত হচ্ছিল। এসব মিশনের মধ্যে ছিল এইড্স, কুষ্ঠরোগ ও যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, সুপ কিচেন, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, এতিমখানা ও বিদ্যালয়। মানব সেবায় এ মহিয়সী নোবেল শান্তি পুরস্কার (১৯৭৯), ভারত (১৯৮০) ছাড়াও প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম (১৯৮৫), ও বালজান পুরস্কারে (১৯৭৮) ভূষিত হন।

No comments:

Post a Comment