Thursday, October 6, 2016

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস

উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলা এবং বাঙ্গালীর ছয় দশকের সংগ্রাম সপ্ন এবং সাহসের সারথী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গর্বিত অংশিদার এই ছাত্র সংগঠনটি। জাতির ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। বাঙ্গালী জাতি হিসেবে জন্ম গ্রহনের আতুর ঘর থেকে শুরু করে আজ অবধি স্বাধীনতা, সংগ্রাম আর শিক্ষার নিশ্চয়তার ছাত্রসমাজের তথা দেশবাসীর জন্য অতন্ত প্রহরী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। 

বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র। তিনি ছিলেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের পর বাঙ্গালীরা নতুন ভাবে শোষনের যাতাকলে পড়ে। যাকে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ''এক শকুনির হাত থেকে অন্য শকুনির হাত বদল মাত্র ''। তাই নতুন রাষ্ট্র পাকিস্থানের সরকার প্রথমে আঘাত হানে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার উপর। বঙ্গবন্ধু তখনই অনুভব করলেন শোষনের কালো দাঁত ভাঙ্গার একমাত্র হাতিয়ার ছাত্র সমাজ। তাই তৎকালিন পাকিস্থান সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া উর্দূ ভাষার বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ তৈরির জন্য ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালিন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতা সম্পন্ন ছাত্র নেতা বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন 'পাকিস্থান ছাত্রলীগ'।বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু। প্রথমে এর নাম ছিলো 'পাকিস্থান ছাত্রলীগ'। সংগঠনটির প্রথম আহবায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রলীগ সাংগঠনিক ভাবে কার্যক্রম শুরু করলে এর সভাপতি মনোনিত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারন সম্পাদক মনোনিত হন খালেক নেওয়াজ খান। ৬৮বছর পর আজ এই বৃহৎ, ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটির গৌরবের পতাকা সভাপতি এইচ সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারন সম্পাদক এস.এম জাকির হোসেন এর হাতে। 

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার এক বছর পর ১৯৪৯ সালে এই ছাত্র সংগঠনটির হাত ধরেই তৎকালীন পাকিস্থানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে 'আওয়ামী মুসলিম লীগে'র। যা পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে এ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। তৎকালিন পাকিস্থান সরকারের শাসন শোষন আর বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জন্মের পর থেকে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনটির নেতাকর্মীরা জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। জাতির পিতা বঙ্গবল্পব্দু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী ৭১'র মহান মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে জীবন উৎসর্গ করেছেন। রনাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন ছাত্রলীগের ১৭ হাজার সাহসী বীর সৈনিক। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও ছাত্রলীগ থেকেই। ১৯৪৮ সালেই মাতৃভাষার পক্ষে ছাত্রলীগ আপোষহীন অবস্থান তৈরি করে। ১১ মার্চ ছাত্রলীগ উর্দুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘট পালন করে। ওই ধর্মঘটের পিকেটিং থেকেই গ্রেফতার হন রাজনীতির মাঠের জ্বলজ্বল করে থাকা তারকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্র, বাঙ্গালীর রাজনীতির রাখাল রাজা, ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা। ছাত্রলীগই প্রথম বাংলা ভাষার জন্য ১০ দফা দাবিনামা পেশ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও আন্দোলন জোরালো করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অবিস্মরনীয়। 

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশান উড়ানোর নেপথ্যের কারিগরও ছিলো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ১৯৫৬ সালের বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়, ৫৭'র শিক্ষক ধর্মঘট এবং ৬২'র শিক্ষা আন্দোলনের পালে সমিরন প্রবাহ করে ছাত্রলীগ। ১৯৬৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারী থেকে ২০ ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রচলন হয় বাংলা সপ্তাহ। বাঙ্গালীর মুক্তির ছয় দফা হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক 'ছয় দফা' আন্দোলনে রাজপথের প্রথম সারিতে অবস্থান ছিল ছাত্রলীগের। এসময় নিজেদের ১১ দফার মাধ্যমে ছাত্রসমাজের রক্তে প্রবাহ সঞ্চার করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছাত্র-গণ আন্দোলন থেকে গণঅভূত্থানে রূপ নেয়। গণজাগরনের ৭০'র নির্বাচনে মুক্তির সনদ ছয় দফাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এক দফার গণভোটে রূপ দেয়। এরপর ৭১'র ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলার আকাশে যে রক্ত স্নাত লাল সূর্যোদয় হয় তাতে পরিসংখ্যানের হিসেবে বিশ্বের বৃহৎ ও সংগ্রামী সংগঠন ছাত্রলীগের আত্মত্যাগী নেতাকর্মীদের সংখ্যা ছিল ১৭০০০ (সতের হাজার)। 

১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ কালপূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ গঠনের সংগ্রাম ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিলো অগ্রগন্য। ১৯৭৫ সারে জাতির পিতা ও তার পরিবারে সদস্যদের নির্মম ভাবে হত্যার পর বাঙ্গালীর জাতির ভাগ্যকালে আবার কালো গ্রাস করে নেয়। স্বৈরশাসক মেজর জিয়া ও তৎপরবর্তী রাজনীতির মাঠে সামরিক চাষবাসের তিক্ত ফসল বাঙ্গালীদের অতিষ্ঠ করে তোলে। যা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে রাজপথে রক্ত দিতে হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শিক্ষার অধিকার প্রসারে শামসুল হক ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরির কমিশনে রিপোর্ট তৈরিতে ছাত্রসমাজের পক্ষে জোড়ালো অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। 

এরপর একটি সফল গণঅভূত্থান পরবর্তী নির্বাচনে দীর্ঘ একুশ বছর পর সরকার গঠন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ছাত্রলীগ মহিয়সী নেত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক নির্দেশ প্রতিপালন করেছে। ১৯৯৮ সালের বন্যা মোকাবেলায় কিছু ব্যক্তির দুর্ভিক্ষের আশংকাকে ভুল প্রমান করেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিন শিফটে রুটি তৈরি করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। তৈরী করেছে দুর্যোগপূর্ন এলাকার মানুষের জন্য খাবার স্যালাইন। দুসময়ে দুর্গত এলাকায় রুটি ও স্যালাইন বিতরন করে মানুষের জীবন রক্ষা করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। যার মাধ্যমে হতাশা ও প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তিদের আশংকার জবাব দিয়েছে ছাত্রলীগ। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল আপোসহীন। নিরক্ষরতা মুক্ত, পোলিও মুক্ত বাংলাদেশ বির্নিমান ও বৃক্ষরোপনের মধ্যেমে বিশ্বের উষ্ণায়ন কমাতে প্রতিটি জেলায় জেলায় কাজ করেছে ছাত্রলীগ। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি জামায়াত জোটের সহিংসতা এবং দেশব্যাপী সাংগঠনিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ প্রতিরোধ রচনা করেছে। পাক আত্মনির্ভর বিএনপি জামায়াত জোটের হাতে এদেশের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে জোড়ালো প্রতিবাদ করেছে ছাত্রলীগ। ২০০১ সালের পর বিএনপি জামায়াত জোটের প্রত্যক্ষ মদদে শান্তির এই ভূখন্ডে জঙ্গীবাদরে উত্থান হলে ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে রাজপথে কঠোর প্রতিবাদ রচনা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অধ্যাপক ড.হুমায়ুন আজাদের উপর মৌলবাদি হামলার প্রতিবাদেও রাজপথে ছিলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় মদদে সর্বকালের সবচেয়ে পৈচাশিক গ্রেনেট হামলার মাধ্যমে বাংলার মানুষের চির আস্থার ঠিকানা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার জীবন নাশের হামালা জোড়ালো প্রতিবাদ জানায় ছাত্রলীগ। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আমাদের প্রিয় নেত্রী বাংলার দু:খি মানুষের একমাত্র আস্থার ঠিকানা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে সামরিক কায়দায় আটকের পর সামরিক বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রাজপথে প্রথম প্রতিবাদ রচনা করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বিতর্কীত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়ে উনিশ মাস কারাবরন করেন ছাত্রলীগের তৎকালিন সাধারন সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রটন সহ অনেক জেষ্ঠ্য নেতা । তবুও প্রাণাধিক প্রিয় নেত্রীর মুক্তির আন্দোলন থেকে ছাত্রলীগকে পশ্চাতে হঠাতে পারেনি শাসক শ্রেনী। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রধর্মঘট পালন করে ছাত্রলীগ প্রিয় নেত্রীর মুক্তির অদম্য আন্দোলন রচনা করে। এরপর ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিজয় নিশ্চিত করতে নিরলস ভাবে কাজ করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিটি মুজিব সৈনিক। এরপর পর বাংলাদেশের সরকার গঠন করে আওয়ামীলীগের নেতৃ্ত্বাধীন মহাজোট। দেশে জননেত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে শুরু হয় দিন বদলের সরকারের পথ চলা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী সাংগঠনিক সভানেত্রীর পদ থেকে হারাতে হয় আমাদের প্রিয় নেত্রীকে।

২০০১ সাল পরবর্তী সময়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর হাতে দেশ জিম্মি থাকার প্রেক্ষাপটে ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করেছিল সাতটি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় ছাত্র ঐক্য, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি ও জাতীয় ছাত্র ফোরাম সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। অতীতে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের বর্তমান সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস.এম জাকির হোসেনের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় ও থানায় যুদ্ধাপরাধমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।  বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সমাপ্ত করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী রাজপথে সাহসী ভূমিকা রাখছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে  এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অগণিত নেতাকর্মীকে শহীদ হতে হয়েছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর ইতিকথা

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বাংলা অর্থ: বাংলাদেশ গণসংঘ)।
বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। এই রাজনৈতিক দলটির গোড়াপত্তন হয় ২৩ জুন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। পরবর্তী কালে এর নাম ছিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। ১৯৭০ সাল থেকে এর নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পরিচিত। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই সংগঠনটির নামাকরণ করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

প্রতিষ্ঠাঃ
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। পরবর্তীকালে, ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নাম রাখা হয়: 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'।

আওয়ামী লীগের জন্মসূত্রের সঙ্গে ঢাকা ১৫০ নম্বর মোগলটুলিস্থ পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের উদ্যোগের সম্পর্ক অনস্বীকার্য। ২৩ জুনের সম্মেলনের আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন শওকত আলী। তার উদ্যোগে ১৫০ নং মোগলটুলিস্থ শওকত আলীর বাসভবন এবং কর্মী শিবির অফিসকে ঘিরে বেশ কয়েক মাসের প্রস্তুতিমূলক তৎপরতার পর ২৩ জুনের কর্মী সম্মেলনে দলের ঘোষণা দেয়া হয়। শওকত আলীর অনুরোধে কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি মামলা পরিচালনার কাজে ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিম লীগ ছেড়ে ভিন্ন একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন। শওকত আলী এ পরামর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করেন। এসময় কর্মী শিবিরের প্রধান নেতা ছিলেন শামসুল হক। কামরুদ্দীন আহমদ, মো. তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আলমাস, শামসুজ্জোহা প্রমুখ প্রথম দিকে এবং পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমান কর্মী শিবির কেন্দ্রিক রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন। মুসলিম লীগের আবুল হাশিম-সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের অন্যায় কাজগুলোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার লক্ষ্যেই এখানে কর্মী শিবির গড়ে তুলেছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালে আসামের ধুবড়ী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকা এলে তার সঙ্গে শওকত আলীর আলোচনা হয়। শওকত আলী মওলানাকে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার কথা জানান। এসময় মওলানা ভাসানী আলী আমজাদ খানের বাসায় অবস্থান করছিলেন। শওকত আলীর সঙ্গে তার প্রাথমিক আলোচনা সেখানেই হয়। এই আলোচনার সূত্র ধরে নতুন দল গঠনের জন্য একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন শওকত আলী। সেজন্যে ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে একটি বৈঠকের আয়োজন করা হয়। মওলানা ভাসানী সেই বৈঠকে যোগদান করেন। এসময় খোন্দকার আবদুল হামিদের সঙ্গে পরামর্শ করে শওকত আলীর উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক এবং খন্দকার মুশতাক আহমদকে দপ্তর সম্পাদক করে অন্যদেরসহ একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।

উপরোক্ত সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন রোজ গার্ডেনে নতুন দল গঠনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এক সম্মেলন আহ্বান করে। রোজ গার্ডেনে ২৩ জুনের বিকেল ৩টায় সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শওকত আলী, আনোয়ারা খাতুন, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুল জব্বার খদ্দর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আতাউর রহমান খান, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ(কুষ্টিয়া), ইয়ার মুহম্মদ খান, মওলানা শামসুল হক, মওলানা এয়াকুব শরীফ, আবদুর রশিদ প্রমুখ।

প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোষাধ্যক্ষ হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। এসময় শেখ মুজিব কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। অন্যদিকে, পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।

২৪জুন বিকেলে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রকাশ্যে জনসভা করে। সভায় আনুমানিক প্রায় চার হাজার লোক উপস্থিত হয়।

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার 'মুকুল' প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব। উল্লেখ্য যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিলো তৎকালীন পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যাক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর দলটি কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।

১৯৫৪ সালের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।

২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

১৯৫৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় সম্মেলনে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নতুন নাম রাখা হয়: 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ'।

পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দল ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।[৫]

মূলনীতিঃ
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
ক) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংহত করা এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা সমুন্নত রাখা।
খ) প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ করা। 
গ) রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি এবং কল্যাণ নিশ্চিত করা। 
ঘ) মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।

পররাষ্ট্রনীতিঃ
সকলের সাথে বন্ধুত্ব। কারও প্রভুত্ব নয়, কারো সাথে বৈরিতা নয়।

অঙ্গীকারঃ
একটি উন্নত, সমৃদ্ধ কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী রূপকল্প সম্বলিত এই ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচির মৌলিক লক্ষ্য ও অঙ্গীকার হইবে-
১। স্বাধীনতার আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা।
২। মানবসত্তার মর্যাদা ও মানবিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি।
৩। বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য ও সংহতির বিধান।
৪। সংসদীয় গনতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান। জনগণের পছন্দমতো ভোটাধিকার প্রয়োগের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
৫। একটি গণমুখী, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক দক্ষ জনপ্রশাসন ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা।
৬। তৃণমূল পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার সকল স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা।
৭। নর-নারী, ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নির্বিশেষে মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধান এবং তাদের উন্নত জীবন বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ প্রদান।
৮। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার বিলোপ সাধন।
৯। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। সন্ত্রাস ও দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গঠন।
১০। নারী নির্যাতন বন্ধ, নারীর অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণ এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সুনিশ্চিতকরণ।
১১। শিশুর অধিকার সংরক্ষণ, তাদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশের সুযোগের নিশ্চয়তা বিধান এবং যুব সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
১২। সংবাদপত্রসহ সকল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা।
১৩। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ মানুষের জীবন ধারণের মৌলিক সমস্যার সমাধান এবং কর্মের অধিকার এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন নিশ্চিত করা।
১৪। অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার অবসান, দারিদ্র্য বিমোচন, অধিকতর কর্মসংস্থান, বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, একপাক্ষিক বৈদেশিক নির্ভরশীলতা কাটানো, ব্যাক্তিখাত এবং রাষ্ট্রীয় ও ব্যাক্তিখাতের যৌথ উদ্যোগে (পিপিপি) উৎপাদনমুখী বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। একটি শিল্পসমৃদ্ধ জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি রচনা করা।
১৫। সর্বাঙ্গীণ গ্রামীণ-উন্নয়ন, ভূমি ও কৃষিব্যবস্থার আমূল সংস্কার, কৃষিতে বিশ্বায়নের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা, আধুনিকায়ন, কৃষিতে টেকসই প্রযুক্তির ব্যবস্থা এবং সমবায় ব্যবস্থা বহুমুখীকরণ ও ফলপ্রসূ করা।
১৬। খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতার ধারা অব্যাহত রাখিয়া জনগণের খাদ্যের অধিকার তথা ভাতের অধিকার নিশ্চিত করা, কৃষিপণ্যের লাভজনক দামের নিশ্চয়তা বিধান।
১৭। জাতীয় স্বার্থে প্রাকৃতিক সম্পদের যুক্তিসংগত ব্যবহার নিশ্চিত করা, দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা, বিদ্যুতায়ন, যোগাযোগ, আইটি খাতসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন।
১৮। মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষার প্রসার ও মানোন্নয়নে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান। সমাজের প্রয়োজনের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ সার্বজনীন, সুলভ ও প্রগতিশীল শিক্ষানীতি এবং ব্যবস্থার প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ধারাকে উৎসাহিতকরণ।
১৯। বাঙালি জাতির সভ্যতা, কৃষ্টি, ভাষা এবং শিল্প সাহিত্যের বিকাশ নিশ্চিতকরণ। দেশের আদিবাসী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও উপজাতীয় জনগণের জীবনধারা, ভাষা-সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা।
২০। শ্রমজীবী, সমাজের দুর্বল, অনগ্রসর, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে মানবেতর জীবন হইতে উত্তরণে সার্বিক সহায়তা প্রদান। পঙ্গু, অসহায়, বিধবা, দরিদ্র, বয়স্ক, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা।
২১। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান বিপদ মোকাবিলায় বৈশ্বিক ও দেশীয় উদ্যোগ গ্রহণ। পানিসম্পদের প্রাপ্যতা, সংরক্ষণ ও যথাযথ ব্যাবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ। পরিবেশ সংরক্ষণ, বন সৃজন ও সামাজিক বনায়ন সম্প্রসারণে উৎসাহিত করা, প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা এবং গ্রিন হাউজ এফেক্ট রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২২। অপরিকল্পিত নগরায়ণ রোধ, শহরাঞ্চলে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূর করা। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত পরিকল্পিত গ্রামীণ জনপদ গড়িয়া তোলা।
২৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও বিশ্বশান্তি রক্ষার লক্ষ্যে আধুনিক, যুগোপযোগী ও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা।
২৪। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতির ভিত্তি হবে সকলের সহিত বন্ধুত্ব, কারো সহিত বৈরিতা নয়। বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সকল প্রচেষ্টায় সাহায্য ও সহযোগিতা করা এবং সন্ত্রাসবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জাতি ও জনগণের ন্যায়সঙ্গত মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করা।
উল্লিখিত লক্ষ্যে ও উদ্দেশ্যে বর্ণিত প্রস্তাবনা, মূলনীতি ও অঙ্গীকার অনুসরণ এবং বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্য, উদ্দীপনা এবং নবজাগরণ সৃষ্টিতে আওয়ামী লীগ সর্বদা সচেষ্ট থাকিবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আরাধ্য এক উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অবিচল নিষ্ঠা, সততা, শৃঙ্খলা ও দৃঢ়তার সহিত আত্মনিয়োগ করিবে।



আন্দোলনঃ

৬ দফা আন্দোলনঃ
ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি Federal বা যৌথরাষ্ট্র এবং ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই Federation বা যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। ছয় দফার সমর্থনে সর্ব প্রথম চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী লালদিঘীর পাড়ে চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর তৎকালীন বৃহত্তর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্টাতা সাধারণ সম্পাদক এক দফার প্রবক্তা চট্টল শার্দূল জননেতা মরহুম এম এ আজিজের নেত্রীত্বে প্রথম প্রকাশ্যে সভা করেন বঙ্গবন্ধু। সেই সভায় মরহুম এম এ আজিজ ঘোষনা করেন যে ছয় দফা না মানলে এক দফার আন্দোলন চলবে, সেটা হচ্ছে স্বাধীনতার আন্দোলন।পরবর্তীতে এই ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানঃ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতিক সংগ্রামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ আরো কিছু ছাত্র সংগঠন এক সাথে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে তাদের ঐতিহাসিক এগারো দফা কর্মসূচী পেশ করেন যা মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে হিসেবে সহায়তা করে।

একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনঃ
গণআন্দোলন ও আইয়ুবের পতনের পটভূমিতে '৭০ এর নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় (জাতীয় পরিষদ) পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন দখল করে আওয়ামী লীগ ৩১৩ আসন-বিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠনে ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পায় দলটি। জাতীয় পরিষদের সাতটি মহিলা আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের দশটি মহিলা আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার পথ বেছে নেয়।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনঃ
১৯৮৭ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে। এই আন্দোলন চলাকালে ১০ই নভেম্বর পুলিশের গুলিতে যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন নিহত হন।


সরকার গঠনঃ
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট-সরকার গঠন করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৬৯ আসনের মধ্যে ২৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ও শোষণের ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ সংগ্রাম করে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩০টি আসন লাভ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। ২০১৪ সালের ৫জানুয়ারী একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পূণরায় সরকার গঠন করে।

১৯৫৪ এর প্রাদেশিক নির্বাচন ও ফলাফল

নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
নির্বাচন ১৯৫৪  ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ এবং পাঁচটি দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দলগুলো ছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, এ. কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম, হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল এবং খিলাফতে রববানী পার্টি।

মার্চ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০৪টি আসনের জন্য ১২৮৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৫টি আসনে প্রার্থীগণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত ২২৮টি আসনের জন্য প্রার্থী ছিলেন ৯৮৬ জন, সাধারণ হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত ৩০টি আসনের জন্য ১০১ জন প্রার্থী এবং তফসিলী সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত ৩৬টি আসনের জন্য প্রার্থী ছিলেন ১৫১ জন। অমুসলিমদের আসনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তাদের মধ্যে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ পার্টি এবং তফসিলী ফেডারেশনের প্রার্থী ছিলেন। মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১,৯৭,৪৮,৫৬৮ জন। তাদের মধ্যে ৭৩,৪৪,২১৬ জন ভোটার (৩৭.১৯%) ভোট দেন। অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক লোক ভোট দেওয়ার কারণ ছিল গ্রামাঞ্চলের অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা এবং মুসলিম মহিলাদের ঘরের বাইরে যেতে অনীহা।

এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২২৮টি আসন লাভ করে। এর মধ্যে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৯টি আসনও ছিল। ১৯৩৭ সাল থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষমতায় আসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৭টি আসন। যুক্তফ্রন্টের ২২৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ পায় ১৪৩টি আসন, কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮, নেজামে ইসলাম ২২, গণতন্ত্রী দল ১৩, এবং খেলাফতে রববানী পার্টি পায় ২টি আসন। অমুসলিম আসনে কংগ্রেস পায় ২৫টি, তফসিলী ফেডারেশন ২৭টি এবং সংখ্যালঘুদের যুক্তফ্রন্ট পায় ১৩টি আসন।

নির্বাচনী প্রচারণায় যুক্তফ্রন্ট প্রচার করে ২১-দফার একটি ম্যানিফেস্টো। এ দফাগুলির মধ্যে ছিল: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, জমিদারি প্রথা বিলোপ, পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, সমবায় পদ্ধতিতে চাষবাস, উদ্বাস্ত্তদের পুনর্বাসন, বন্যা প্রতিরোধের স্থায়ী ব্যবস্থা, কৃষির আধুনিকায়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, সকল কালাকানুন রহিতকরণ, সমন্বিত বেতন কাঠামো প্রবর্তন, দুর্নীতি দমন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, ভাষা শহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা উন্নয়নের কেন্দ্রে রূপান্তর, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা এবং পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। এসব দাবি উপস্থাপন করেন এ. কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,  মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। বামপন্থী দলগুলির কর্মীদের সহায়তায় ফ্রন্টের নেতাগণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েও নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে সক্ষম হন। যুক্তফ্রন্ট যেসব বিষয় জনসমক্ষে তুলে ধরে সেগুলি ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য ছাত্রদের আত্মাহুতি এবং লবণ, চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান মূল্য। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বহু নেতাকর্মীর ধরপাকড়ে জনসাধারণ মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।

কিন্তু যুক্তফ্রন্টের বিজয় অতি শীঘ্রই অসার প্রমাণিত হয়। ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামান কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের আহবান জানান। তিনি ৩ এপ্রিল সরকার গঠন করেন, কিন্তু আওয়ামী মুসলিম লীগকে এতে শরিক করেন নি। এর ফলে ফ্রন্টে একটি সঙ্কট সৃষ্টি হয় এবং ফজলুল হক বাধ্য হয়ে ১৫ মে তাঁর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত করে আওয়ামী লীগের আবুল মনসুর আহমদ, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুস সালাম খান এবং হাশিমুদ্দিনকে এর অন্তর্ভুক্ত করেন। ঐ দিনই নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে প্রায় ১৫০০ শ্রমিক নিহত হয়। এর জন্য কমিউনিস্ট কর্মিদের দায়ী করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় ফজলুল হক সরকারকে দায়ী করা হয়। ৩০ মে তাঁর মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে সরাসরি গভর্নরের শাসন চালু করা হয়। ফ্রন্টের ১৬০০ নেতা-কর্মীকে আটক করে জেলে পাঠানো হয়। এর মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত ৩০ জন সদস্যও ছিলেন। আওয়ামী লীগ অবশ্য ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট ক্ষমতায় আসে। তখন মুখ্যমন্ত্রী হন আতাউর রহমান খান। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁদের পদত্যাগ করতে হয়।

সূত্রঃ বাংলাপিডিয়া।

যুক্তফন্ট্র এর ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচী

একুশ দফা ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্ধন্দ্বিতা এবং পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শাসনের অবসানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী মুসলীম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনী মোর্চা গঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ. কে. ফজলুল হক, আওয়ামী মুসলীম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং নেতা হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২১টি প্রতিশ্রুতি সহকারে যে নির্বাচনী কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় তা একুশ দফা কর্মসূচী নামে পরিচিত।

দফা সমূহঃ
১। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।
২। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ এবং খাজনা হ্রাস ও সার্টিফিকেট মারফত খাজনা আদায় রহিত করা হবে।
৩। পাট ব্যবসা জাতীয়করণ এবং তা পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় আনা এবং মুসলিম লীগ শাসনামলের পাট কেলেঙ্কারির তদন্ত ও অপরাধীর শাস্তি বিধান করা।
৪। কৃষিতে সমবায় প্রথা প্রবর্তন এবং সরকারি সাহায্যে কুটির শিল্পের উন্নয়ন।
৫। পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা।
৬। কারিগর শ্রেনীর গরিব মোহাজেরদের কর্মসংস্থানের আশু ব্যবস্থা।
৭। খাল খনন ও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশে বন্যা ও দূর্ভিক্ষ রোধ।
৮। পূর্ববঙ্গে কৃষি ও শিল্প খাতের আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশকে স্বাবলম্বী করা এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) মূলনীতি মাফিক শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।
৯। দেশের সর্বত্র অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন এবং শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা।
১০। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার, মাতৃভাষায় শিক্ষাদান, সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ের ভেদাভেদ বিলোপ করে সকল বিদ্যালয়কে সরকারি সাহায্যপুষ্ট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।
১১। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল আইন বাতিল এবং উচ্চশিক্ষা সহজলভ্য করা।
১২। শাসনব্যয় হ্রাস, যুক্তফ্রন্টের কোনো মন্ত্রীর এক হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ না করা।
১৩। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ঘুষ-রিশ্‌ওয়াত বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন।
১৪। জননিরাপত্তা আইন, অর্ডিন্যান্স ও অনুরূপ কালাকানুন বাতিল, বিনাবিচারে আটক বন্দির মুক্তি, রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্তদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার এবং সংবাদপত্র ও সভাসমিতি করার অবাধ অধিকার নিশ্চিত করা।
১৫। বিচারবিভাগকে শাসনবিভাগ থেকে পৃথক করা।
১৬। বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে কম বিলাসের বাড়িতে যুক্তফ্রন্টের প্রধান মন্ত্রীর অবস্থান করা এবং বর্ধমান হাউসকে প্রথমে ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষনাগারে পরিণত করা।
১৭। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে শহীদ মিনার নির্মাণ করা এবং শহীদদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
১৮। একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষনা করা।
১৯। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বায়ত্তসাশন এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মূদ্রা ব্যতীত সকল বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের অধীনে আনয়ন, দেশরক্ষা ক্ষেত্রে স্থলবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তানে এবং নৌবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রনির্মাণ কারখানা স্থাপন ও আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা।
২০। কোনো অজুহাতে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কর্তৃক আইন পরিষদের আয়ু না বাড়ানো এবং আয়ু শেষ হওয়ার ছয়মাস পূর্বে মন্ত্রিসভার পদত্যাগপূর্বক নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।
২১। যুক্তফ্রন্টের আমলে সৃষ্ট শূন্য আসন তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী পরাজিত হলে মন্ত্রিসভার পদত্যাগ করা।

৭০' এর সাধারণ নির্বাচন ও ফলাফল

ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭০ সনে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব
পাকিস্তানে ১৯৭০ সনের অক্টোবরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৯৭১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে যায়।

রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীঃ
নির্বাচনে মোট ২৪ টি দল অংশ নেয়। ৩০০ টি আসনে মোট ১,৯৫৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর পর কিছু প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেয়। মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে ১,৫৭৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করে। আওয়ামী লীগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১৬২টি আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং অবশিষ্টগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে। জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দেয়। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ১৫১। পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ১২০ আসনে প্রার্থী দেয়। তার মধ্যে ১০৩ টি ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা কোন প্রার্থী দেয়নি। পিএমএল(কনভেনশন) ১২৪ আসনে, পিএমএল(কাউন্সিল) ১১৯ আসনে এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ(কাইয়ুম) ১৩৩ আসনে প্রতিদ্বন্দীতা করে।

নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রায় ৬৫% ভোট পড়েছে বলে সরকার দাবী করে। সর্বমোট ৫৬,৯৪১,৫০০ রেজিস্টার্ড ভোটারের মধ্যে ৩১,২১১,২২০ জন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ২৩,৭৩০,২৮০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটার।

ফলাফলঃ













প্রদেশওয়ারী ফলাফলঃ



(বন্ধনীর ভিতরে সংখ্যা মোট ভোটের শতকরা নির্দেশক)
ন্যশনাল এ্যাসেম্বলীতে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সাথে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে।

কনজারভেটিভ দলগুলি নির্বাচনে খুব সুবিধা করতে পারেনি। সম্ভবত একই ধরনের পার্টিগুলো একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দীতার ফলে এমনটি হয়েছে। পিএমএল(কাইয়ুম), পিএমএল(কাউনসিল), পিএমএল কনভেনশন), জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম, জমিয়ত উলেমা-ই-পাকিস্তাতন এবং জামায়াতে ইসলামী একত্রে ৩৭টি আসন পায়।

প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফলঃ
প্রাদেশিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের ২৮৮টি জিতে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের অপর চারটি এ্যাসেম্বলীতে তারা কোন আসন পায়নি। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের এ্যাসেম্বলীতে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ভালো করে কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে কোন আসনে জয় পায়নি। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি(ওয়ালি) এবং পিএমএল(কাইয়ুম) ভালো করে।



ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) এর পটভুমি

পটভূমিঃ
ভাষা আন্দোলন  বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার দাবিতে সংগঠিত গণআন্দোলন। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। স্বাধীনতার পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে  উর্দু। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি ওঠে, বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষার এ দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে। এতে ঢাকার ছাত্র ও  বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষুব্ধ হন এবং ভাষার ব্যাপারে তাঁরা একটি চূড়ান্ত দাবিনামা প্রস্ত্তত করেন; দাবিটি হলো: পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা ও সরকারি কার্যাদি পরিচালনার মাধ্যম হবে বাংলা আর কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু।

ভাষাসংক্রান্ত এই দাবিকে সামনে রেখে সর্বপ্রথম আন্দোলন সংগঠিত করে তমদ্দুন মজলিস। এর নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক আবুল কাসেম। ক্রমান্বয়ে অনেক অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সংগঠন এই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং একসময় তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়।

অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ফোরামে শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা চলে। এতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসভার আয়োজন করে। সভার পরও মিছিল-প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। এ মাসেরই শেষদিকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, যার আহবায়ক ছিলেন তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক নূরুল হক ভূঁইয়া। পরের বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদ সদস্যদের উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তৃতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেস দলের সদস্য  ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বাংলাকেও পরিষদের অন্যতম ভাষা করার দাবি জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই পূর্ব পাকিস্তানের, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী  খাজা নাজিমুদ্দীন বিরোধিতা করলে এ দাবি বাতিল হয়ে যায়। এ খবর ঢাকায় পৌঁছলে ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা বিক্ষুব্ধ হন। আজাদ-এর মতো পত্রিকাও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আনা প্রস্তাবে যারা বিরোধিতা করেছিল তাদের সমালোচনা করে। পরে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন পরিচালনার জন্য একটি নতুন রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠিত হয়, যার আহবায়ক ছিলেন শামসুল আলম।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একটি স্মরণীয় দিন। গণপরিষদের ভাষা-তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া ছাড়াও পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা এবং নৌবাহিনীতে নিয়োগের পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাখার প্রতিবাদস্বরূপ ওইদিন ঢাকা শহরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটিদের দাবি ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা। ধর্মঘটের পক্ষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই শ্লোগানসহ মিছিল করার সময় শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক, অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল ওয়াহেদ প্রমুখ গ্রেপ্তার হন। আব্দুল মতিন, আবদুল মালেক উকিল প্রমুখ ছাত্রনেতাও উক্ত মিছিলে অংশ নেন; বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিরাট সভা হয়। একজন পুলিশের নিকট থেকে রাইফেল ছিনিয়ে চেষ্টা করলে পুলিশের আঘাতে মোহাম্মদ তোয়াহা মারাত্মকভাবে আহত হন এবং তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে ১২-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়।

আন্দোলনের মুখে সরকারের মনোভাব কিছুটা নমনীয় হয়। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে চুক্তিতে তিনি অনেকগুলি শর্তের সঙ্গে একমত হলেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তাঁকে কোনো কিছুই মানানো যায়নি।

১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল  মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। তিনি ঢাকার দুটি সভায় বক্তৃতা দেন এবং দুই জায়গাতেই তিনি বাংলা ভাষার দাবিকে উপেক্ষা করে একমাত্র উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেন। এ সময় সারা পূর্ব পাকিস্তানেই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। জিন্নাহর বক্তব্য তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়ে। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়; এর আহবায়ক ছিলেন আবদুল মতিন।

১৯৫২ সালের শুরু থেকে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে থাকে। এ সময় জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান উভয়েই পরলোকগত। লিয়াকত আলী খানের জায়গায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দীন। রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থারও অবনতি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারাতে থাকে। ১৯৪৯ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। পূর্ব পাকিস্তানে বঞ্চনা ও শোষণের অনুভূতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং এখানকার জনগণ ক্রমেই এই মতে বিশ্বাসী হতে শুরু করে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের জায়গায় তাদের ওপরে আরোপিত হয়েছে নতুন ধরনের আরেক উপনিবেশবাদ। এ প্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন একটি নতুন মাত্রা পায়।


১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন যে, প্রদেশের সরকারি কাজকর্মে কোন ভাষা ব্যবহূত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবল উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় এবং ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন। ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের এক সভায় ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়, যার আহবায়ক ছিলেন কাজী গোলাম মাহবুব। এ সময় সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব পেশ করে। এর বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি (একুশে ফেব্রুয়ারি) সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে  হরতাল, জনসভা ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এসব কর্মসূচির আয়োজন চলার সময় সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সমাবেশ-শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আবুল হাশিমের (১৯০৫-৭৪) সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা হয়। ১৪৪ ধারা অমান্য করা হবে কিনা এ প্রশ্নে সভায় দ্বিমত দেখা দেয় তবে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সঙ্কল্পে অটুট থাকে।

পরদিন সকাল ১১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের একাংশে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রদের সভা হয়। সভা শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ উপাচার্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য ছাত্রদের অনুরোধ করেন। তবে ছাত্র নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে আবদুল মতিন এবং গাজীউল হক নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে। ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের হাজার হাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়। ছাত্ররা পাঁচ-সাতজন করে ছোট ছোট দলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসলে পুলিশ তাঁদের উপর লাঠিচার্জ করে, ছাত্রীরাও এ আক্রমন থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে  রফিক উদ্দিন আহমদ,  আবদুল জববার,  আবুল বরকত (রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ শ্রেণীর ছাত্র) নিহত হয়। বহু আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং তাঁদের মধ্যে সেক্রেটারিয়েটের পিয়ন আবদুস সালাম মারা যায়। অহিউল্লাহ্ নামে আট/নয় বছরের এক কিশোরও সেদিন নিহত হয়।

এ সময় গণপরিষদের অধিবেশন বসার প্রস্ত্ততি চলছিল। পুলিশের গুলি চালানোর খবর পেয়ে গণপরিষদ সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ এবং বিরোধী দলের সদস্যসহ আরও কয়েকজন সভাকক্ষ ত্যাগ করে বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী  নূরুল আমীন বাংলা ভাষার দাবির বিরোধিতা অব্যাহত রেখে বক্তব্য দেন।

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছিল গণবিক্ষোভ ও পুলিশি নির্যাতনের দিন। জনতা নিহতদের গায়েবানা জানাজার  নামায পড়ে ও শোকমিছিল বের করে। মিছিলের উপর পুলিশ ও মিলিটারি পুনরায় লাঠি, গুলি ও বেয়োনেট চালায়। এতে শফিউর রহমানসহ কয়েকজন শহীদ হন এবং অনেকে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। ছাত্ররা যে স্থানে গুলির আঘাতে নিহত হয় সেখানে ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৬৩ সালে এই অস্থায়ী নির্মাণের জায়গায় একটি কংক্রীটের স্থাপনা নির্মিত হয়।

গণপরিষদ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিয়ে একটি বিল পাস করে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অব্যাহত ছিল। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অনুমোদনের মাধ্যমে এই আন্দোলন তার লক্ষ্য অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের (১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬) এক পর্যায়ে এর সদস্য ফরিদপুরের আদেলউদ্দিন আহমদের (১৯১৩-১৯৮১) দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯৫২ সালের পর থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাঙালিদের সেই আত্মত্যাগকে স্মরণ করে দিনটি উদ্যাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে  আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। 

ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ ও পটভূমি

পটভূমি:
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যে কোনভাবে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের হাতে কুক্ষিগত করে রাখা। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই পটভূমিতেই ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বিপুল সংখ্যক লোক একত্রিত হয়; পুরো ময়দান পরিণত হয় এক জনসমুদ্রে। এই জনতা এবং সার্বিকভাবে সমগ্র জাতির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রদান করেন।

পূর্ণাঙ্গ ভাষণ:
ভায়েরা আমার, 
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গনতন্ত্র দেবেন - আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো- এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম- আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো।

তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্র“র আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে- তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কিসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।

ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবী মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন- মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাঁচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।

গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে- শুধু... সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয় - তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু - আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো- কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দুমুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সংগে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম জয় বাংলা।

ভাষণের মূল কয়েকটি দিকঃ

  • বাংলা ভাষার উইকিসংকলনে এই নিবন্ধ বা অনুচ্ছেদ সম্পর্কিত মৌলিক রচনা রয়েছে: সাতই মার্চের ভাষণ;
  • সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা;
  • নিজ ভূমিকা ও অবস্থান ব্যাখ্যা;
  • পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকদের ভূমিকার ওপর আলোকপাত;
  • সামরিক আইন প্রত্যাহারের আহবান;
  • অত্যাচার ও সামরিক আগ্রসন মোকাবিলার হুমকি;
  • দাবী আদায় না-হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক হরতাল চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা;
  • নিগ্রহ ও আক্রমণ প্রতিরোধের আহবান।

১১ দফা আন্দোলন ও পটভূমি

১৯৬৯ সালে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ প্রবল রূপ ধারণ করে। ১৯৬৯ সালের ৪ই জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে এ দেশের ছাত্রসমাজ রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকা শুরু হয় যা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। পরবর্তীতে ১৯৬২ সালের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্বে আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সক্রিয়। অতঃপর তারা ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর হতে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছাত্ররা যে এক সুসংবদ্ব ও সফল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তা ইতিহাসে বিরল যা তারা ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি পেশ করে তার সূচনা করেছিল।





১১ দফা আন্দোলনের পটভূমিঃ
ছাত্রদের ১১ দফা ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে উঠার পিছনে দীর্ঘ সময়ের বাঙালি জাতির ক্ষোভ, অধিকার বঞ্চনা, অবহেলা।
১। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন
১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান যে শিক্ষা কমিশন প্রনয়ণ করা হয়েছিল তাতে বাংলা শিক্ষাকে অত্যন্ত খাট করে দেখা হয়।
২। ছয় দফা আন্দোলন
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বুঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি পেশ করার পর তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে ৮ মে,১৯৬৬ সালে দেশ রক্ষা আইন অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়। এরপর ৭ জুন,১৯৬৬ এ সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সারা দেশে ধর্মঘট ডাকে। ৭ জুন যে ধর্মঘট ডাকে সেই আন্দোলনকারীদের উপর পাকিস্তানী সরকার নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায়। এই দিন প্রায় ১০ জন নিহত হয়। এরপর কয়েকদিনে আওয়ামী লীগের প্রায় ৯৩৩০ জন কর্মী গ্রেফাতার হন। ১৫ জুন ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গ্রেফতার হন এবং ১৬ জুন ইত্তেফাককে নিষিদ্ব করা হয়। তাছাড়া ১৯৬৭ সালের আগষ্ট মাসে রবীন্দ্র সংগীতকে নিষিদ্ব ঘোষণা করা হয়। এসব ঘটনা ছাত্রদেরকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্বে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিষেশ ভূমিকা পালন করে।
৩। আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা
শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার পর ১৮ই জানুয়ারি, ১৯৬৮ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হলেও ঐদিন তার বিরুদ্বে আগরতলা ষড়যন্ত্রমূলক মামলা করা হয়। এই মামলার জন্য তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। বঙ্গবন্ধুসহ মোট ৩৫ জনকে এ মামলার আসামি করা হয়। এদের ভিতর প্রায় সকলে বাঙ্গালী সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের সকল প্রভাবশালী লোকদের পাকিস্তান শাষকগোষ্ঠী আটক করে বাঙ্গালীদের একদম নিস্তেজ করে ফেলে।
৪। জাতীয় নেতৃত্বের বিকল্প ছাত্র নেতৃত্ব সৃষ্টি সারা দেশে যখন অসংখ্য নেতা-কর্মী আটক হতে থাকে তখন আন্দোলন একেবারে স্তিমিত হয়ে আসছিল। এমতাবস্থায় এদেশের ছাত্রগণ চিন্তা-ভাবনা শুরু করল যে দেশের এই নাজুক পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ছাত্র আন্দোলনের বিকল্প আর কোন পথ থাকতে পারে না। ছাত্রলীগের দুটি অংশ এবং ছাত্র ইউনিয়নের দুটি অংশ (মতিয়া ও মেনন) ডাকসুর উদ্যোগে একত্রিত হয়। অর্থাৎ,ডাকসুসহ মোট ৫টি সংগঠনের সম্বনয়ে ৫ই জানুয়ারি, ১৯৬৯(অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেছেন ৪ঠা জানুয়ারি) ডাকসু কার্যালয় “সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ”(SAC) গঠিত হয়। তোফায়েল আহমেদ, কামরান নাজিম চৌধুরীসহ আরও অনেকে এর নেতৃত্বে ছিলেন। এখানে তারা সকল ছাত্রনেতাগণ ১১টি বিষয় কর্মসূচী স্বাক্ষর করেন।

১১ দফা কর্মসূচী সমূহঃ
১। শিক্ষা সমস্যার আশু সমাধান। অর্থাৎ, হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত আইন বাতিল করা এবং ছাত্রদের সকল মাসিক ফি কমিয়ে আনা।
২। প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং পত্রিকাগুলোর স্বাধীনতা দেওয়া এবং দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনার নিষেধাজ্ঞা তুলে ফেলা।
৩। ছয় দফা দাবির প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ন সায়ত্তশাষন প্রতিষ্ঠা।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশগুলোকে (অর্থাৎ, উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ,বেলুচিস্তান,পাঞ্জাব,সিন্ধু) স্বায়ত্তশাসন দিয়ে একটি ফেডারেল সরকার গঠন।
৫। ব্যাংক, বীমা, পাটকলসহ সকল বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ।
৬। কৃষকদের উপর থেকে কর ও খাজনা হ্রাস এবং পাটের সর্বনিম্নমূল্য ৪০ টাকা(স্বাধীনতার দলিলপত্রে উল্লেখ রয়েছে) ধার্য করা।
৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং শ্রমিক আন্দোলনে অধিকার দান।
৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রন ও জল সম্পদের সার্বিক ব্যবহারের ব্যবস্থা গ্রহন।
৯। জরুরী আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার।
১০। সিয়াটো (SEATO), সেন্ট্রো (CENTRO)-সহ সকল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং জোট বহির্ভূত নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ।
১১। আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ব্যাক্তি সহ দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মুক্তি ও অন্যান্যদের উপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার। 

অবশেষে ২২শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পরের দিন রেসকোর্স ময়দানে এক আড়ম্বরপূর্ণ সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব কে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

 সুত্রঃ উইকিপিডিয়া।

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু ব্যক্তির নাম, সময়কাল, ঘটনাপঞ্জি সময়ের বিচারে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে। এসবের মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ও তাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম। এসব ঘটনা বা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। আর আছেন এ দেশের কালজয়ী ছাত্রনেতারা। এসব সময়কাল বা ঘটনা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনে সহায়তা করেছে অথবা দেশকে তার স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে গেছে। তবে বলতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইটা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে; আর সেই অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এই আন্দোলনের সূচনা করেছিল এই দেশের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো, যার নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগঠন বা ডাকসু। তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদে ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ (মেনন-মতিয়া)। পরবর্তীকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সব কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাতে যোগ দেয় মোনায়েম খানের পেটোয়া ছাত্রসংগঠন থেকে বের হয়ে আসা মাহবুবুল হক দোলন ও নাজিম কামরান চৌধুরীর নেতৃত্বে এনএসএফের একটি অংশ। উল্লেখ্য, এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন ছাত্রলীগের তোফায়েল আহমেদ (ইকবাল হল, পরবর্তীকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও এনএসএফের নাজিম কামরান চৌধুরী (জিন্নাহ হল, পরবর্তীকালে সূর্য সেন হল)। বলে রাখা ভালো, সে সময় ডাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো পরোক্ষ ভোটে আর ছাত্রাবাসওয়ারি রোটেশনের ভিত্তিতে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পুরোভাগে ছিলেন এ দেশের ছাত্রনেতারা, যাঁদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী ছাড়াও ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শামসুদ্দোহা, সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, মোস্তাফা জামাল হায়দার, খালেদ মোহাম্মদ আলী, আবদুর রউফ, মাহবুব উল্লাহ, মাহবুবুল হক দোলন প্রমুখ (কারো নাম বাদ পড়লে তা অনিচ্ছাকৃত)। তবে বলে রাখা ভালো, সিরাজুল আলম খানের আচরণ এখনকার মতো তখনো ছিল বিভ্রান্তিমূলক ও রহস্যাবৃত। ছাত্রনেতারা গঠন করেছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাঁদের বাইরে ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে আর যে ছাত্রনেতারা যুক্ত থেকেছেন তাঁদের মধ্যে নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী অন্যতম। ওই মাপের ছাত্রনেতা বাংলাদেশে আর জন্মগ্রহণ করেননি। ভবিষ্যতে করবে তেমন আলামত এখন আর দেখা যায় না। কেমন ছিল সে সময়ের ছাত্রনেতৃত্ব তা বর্তমান সময়ের ছাত্রনেতারা কল্পনাও করতে পারবেন না। এই সময় বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা জেলে ছিলেন। একমাত্র উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতা, যিনি মুক্ত ছিলেন তিনি হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। তাঁকেও মাঝেমধ্যে আটক করা হতো। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন হিসেবে, যেমনটি শুরুতে বলেছি। শুরুতে এই আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররাও শামিল ছিল। কিন্তু বাঙালি ছাত্রদের মতো তাদের বড় মাপের কোনো ছাত্রনেতা না থাকার কারণে তারা পুরো সময় এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে পারেনি। সুতরাং ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ও পরবর্তীকালে গণ-অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি ছিল এ দেশের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো।

১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয়। এর আগে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য একবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনো চাননি পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা একটি গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হোক। তাঁরা মনে করতেন, তা-ই যদি হয়, তাহলে তাঁরা জিন্নাহ সৃষ্ট পাকিস্তানে যে অবারিত ক্ষমতা ভোগ করছেন তা খর্ব হয়ে যাবে। পাকিস্তানের বর্তমান চরম দুর্দশার জন্য সে দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র সমানভাবে দায়ী। সেই যাত্রায় সংবিধান প্রণয়নের প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রই। অনেক চেষ্টার পর ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হলো এবং এই সংবিধানের আওতায় ১৯৫৮ সালে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তা নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু আবারও সেই সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইসকান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূনকে বরখাস্ত করে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান বাতিল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন আর সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ঠিক ২০ দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইসকান্দার মির্জাকে উত্খাত করে নিজে ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেন। সব সামরিক শাসকের মতো আইয়ুব খানও ক্ষমতা দখল করে ঘোষণা করেন, তিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং স্বল্পতম সময়ে বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যাবেন। কিন্তু সেই আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়েছিল। প্রাণ দিতে হয়েছিল কয়েক শ মানুষকে। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর এটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার নিরাপত্তা বা স্বার্থের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। এই উপলব্ধি থেকেই শেখ মুজিব (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি) ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা উত্থাপন করেন। এই ছয় দফাকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান ভাঙার পরিকল্পনা হিসেবে মূল্যায়ন করে এবং একপর্যায়ে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরা পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ভারতের সহায়তায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাসে শেখ মুজিব ও তাঁর সতীর্থদের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়। বিচারটি রাষ্ট্রদ্রোহের এবং এর অবধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

যদিও আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেছিলেন দ্রুত ক্ষমতা ছাড়বেন বলে; কিন্তু নানা ছলচাতুরী করে তিনি তাঁর অগণতান্ত্রিক শাসন ১০ বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করে ১৯৬৮ সালে ‘উন্নয়নের এক দশক’ উদ্যাপন নামে এক তামাশার উৎসবের আয়োজন করেন। এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আইয়ুব খানের এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাটা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, সন্দেহ ও সীমাহীন ক্ষমতা আর বৈষয়িক লোভ। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা ঘোষণা করেন তখন তাঁকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগেও ভাঙন দেখা দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। আইয়ুব খান যখন তাঁর ‘দশক’ পালন করছেন তখন ঢাকা সেনানিবাসে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য একটি তামাশার মামলা আর তার বিচার চলছে। এই সময় মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দানা বাঁধা শ্রমিক-ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পুরোভাগে চলে আসেন। উল্লেখ্য, এই সময় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা হয় জেলে অথবা গা বাঁচিয়ে চলছেন। পূর্ব বাংলা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালের ১৩ নভেম্বর আইয়ুব খান পিপলস পার্টির প্রধান ও তাঁর এককালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করেন। দ্রুততম সময়ে অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদেরও তিনি কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এই সময় আইয়ুব খান বস্তুতপক্ষে নিজের জন্য নিজের অজান্তেই একটি ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করছিলেন। এই সময় আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন অবসানকল্পে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট বিভিন্ন কর্মসূচি দিতে থাকে এবং দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি উত্থাপন করে। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে যায় ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ঘোষিত ১১ দফা কর্মসূচি। এত কিছুর মধ্যেও আইয়ুব খানের আচরণ ছিল অনেকটা বেপরোয়া। কারণ তাঁর পেছনে ছিল পাকিস্তানের সুবিধাভোগী সামরিক-বেসামরিক আমলা আর যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমর্থন। ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর আইয়ুব খান তাঁর গঠিত কনভেনশন মুসলিম লীগের এক কর্মী সম্মেলনে বলেন, ‘বিক্ষোভ করে সরকারকে টলানো যাবে না।’ তিনি সব সময় মনে করতেন, ক্ষমতা দখল করে তিনি পাকিস্তানে একটি বিপ্লব সাধন করেছেন। ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দুটি সভায় মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে, যাতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছাড়াও অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ২. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ সব রাজনীতিবিদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেনি, একই সঙ্গে তারা রাজপথের আন্দোলনও বেগবান করে। পেছন ফিরে তাকালে আজ মনে হয় ১৯৬৯ সালে বাংলার দামাল ছাত্ররা পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে শুধু এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন তা-ই নয়, বরং ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে তাঁদের সেই চ্যালেঞ্জ তাঁরা বাস্তবায়ন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ছিল জিন্নাহর পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক আর ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই কফিনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা (মেনন) আসাদুজ্জামান আসাদের মৃত্যু। এদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকাল ১১টা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রদের এক সমাবেশের পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক মিছিল বের হয়। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে চানখাঁরপুল পৌঁছলে পুলিশ আর ইপিআর (তত্কালীন সীমান্ত রক্ষীবাহিনী) বিনা উসকানিতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ ও টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে। আহত হন অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আসাদুজ্জামান আসাদ। এই এক রাজপথের সৈনিক আসাদের মৃত্যু ছাত্র-জনতার রাজপথের আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তর করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারা দেশে দিনের পর দিন হরতাল পালিত হতে থাকে। অন্যদিকে সরকার ১৪৪ ধারা, কারফিউ, গণগ্রেপ্তারসহ দমন-পীড়নের মাধ্যমে দেশের জনগণের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। রাস্তায় নামানো হয় সেনাবাহিনী। ২৪ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। রাতে কারফিউ ভেঙে ছাত্র-জনতা রাজপথে মিছিল বের করলে সেনাবাহিনী আর ইপিআর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে অসংখ্য মানুষকে হয় হত্যা করে অথবা আহত করে। তেজগাঁও এলাকায় শিশুকে দুগ্ধপানরত অবস্থায় নিহত হন আনোয়ারা বেগম নামের এক মা। টঙ্গী আর আদমজীতে নিহত বা আহত হন অসংখ্য শ্রমিক ও খেটেখাওয়া মানুষ। এই আন্দোলনের একটি বড় দিক ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণ পুলিশ হোক বা সেনাবাহিনী, তাদের কাছ থেকে নিহত বা আহত ব্যক্তিদের ছিনিয়ে নিত এবং প্রায় সময় পল্টন ময়দানে তাঁদের জানাজা হতো এবং তাতে প্রায়ই মওলানা ভাসানী ইমামতি করতেন। একপর্যায়ে বিক্ষোভরত জনতা প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তানের প্রকাশনা ভবন ও প্রেসে অগ্নিসংযোগ করে। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ সরকারের পত্রিকা হলেও মাঝেমধ্যে তারা চেষ্টা করত জনগণের পক্ষে কথা বলতে। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ। আইয়ুব খানের আস্থাভাজন হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভারের ভূমিকা ছিল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো।

যে আন্দোলন এ দেশের ছাত্ররা আইয়ুববিরোধী আন্দোলন হিসেবে শুরু করেছিলেন, সেই আন্দোলনই আসাদের মৃত্যুর পর ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। এই দিনই মতিউর শহীদ হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ে। আইয়ুব খান হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন দেশের শাসনক্ষমতা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসের কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যার প্রতিবাদে উন্মত্ত জনতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি এস এ রহমানের সরকারি বাসভবন (বর্তমান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে) আর সরকারি কৌঁসুলিদের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে তা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। বিচারপতি এস এ রহমান কোনো রকমে দেয়াল টপকে জীবন রক্ষা করেন। অন্যরাও একইভাবে পালিয়ে জীবন বাঁচান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সামসুজ্জোহা। ২০ জানুয়ারির পর পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী আর সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রায় ৩০০ মানুষ প্রাণ দেন, যার অধিকাংশই ছিলেন পূর্ব বাংলার। এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে টঙ্গী ও আদমজী এলাকার শ্রমিকরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এবং অকাতরে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ছাত্র-জনতার তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে মামলায় অভিযুক্ত সব বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

শেষ রক্ষা হিসেবে আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন, যা সংকট নিরসনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লে আইয়ুব খান ২৫ মার্চ পাকিস্তানের শাসনভার দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে তুলে দেন। ইয়াহিয়া খান বস্তুতপক্ষে জিন্নাহর পাকিস্তানের জানাজায় ইমামতি করেন। পেছন ফিরে তাকালে এখন এটি কল্পনা করাও অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে কেমন ছিল সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের বা গণ-অভ্যুত্থানের মূল নায়ক ছিলেন এ দেশের ছাত্র-জনতা আর মেহনতি মানুষ। নেতৃত্বে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সামনে থেকে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন আজকের তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ। সেই আন্দোলনের রাজপথের একজন সৈনিক হিসেবে এখনো গর্ব বোধ করি। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সব শহীদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।


লেখক : আব্দুল মান্নান।
বিশ্লেষক ও গবেষক

ঐতিহাসিক ছয় দফা, ১৯৬৬

৭ জুন-একটি স্মরণীয় দিন, একটি মহান দিবস। বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি Federal বা যুক্তরাষ্ট্র। ৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে যে হরতাল-আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা নির্যাতন, গ্রেফতার ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ লাভ করে। আর ছয় দফাকেই বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ বলা হয়ে থাকে।


১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবিসমূহ 

প্রথম দফা : 
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের (Legislatures) ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারনের সরাসরি ভোটে।

দ্বিতীয় দফা : 
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু'টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।

তৃতীয় দফা : 
মুদ্রা বা অর্থ-সমন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু'টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু'টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
(খ)বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

চতুর্থ দফা : 
রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

পঞ্চম দফা : 
বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন বাধা-নিষেধ থাকবে না।

(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বানিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং নিজেদের প্রয়োজনে বানিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

ষষ্ঠ দফা : 
আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ রাষ্ট্র গুলিকে নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।



ছয় দফা দাবি উত্থাপণের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইয়ুব খান এটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি হিসেবে আখ্যা দেন এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু হিসেবে অভিহিত করেন। একইসাথে তিনি এই দাবিনামাকে কঠোরভাবে দমনের হুমকি দেন। কিন্তু এতে বিচলিত না হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে যায় আওয়ামী লীগ।

বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে তিন মাসব্যাপী এক ব্যাপক গণসংযোগ কর্মসূচি গ্রহণ করেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে পৌঁছে যায় ছয় দফা। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম তিন মাসে মোট আটবার গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ছয় দফা কর্মসূচির সমর্থনে ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এসময় পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ১৩ জন ব্যক্তি নিহত হন। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু আইয়ুব প্রশাসনের এসকল পদক্ষেপে আন্দোলন দমে না গিয়ে উল্টো আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ছয় দফার দাবিতে গণআন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। এটি জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। ছাত্রসমাজও এই ছয় দফার সমর্থনে তাদের এগারো দফা দাবি পেশ করে। আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ; আইয়ুব শাসনের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে বাঙালি সমাজ।