Sunday, October 9, 2016

কৌশিক থেকে মাশরাফিঃ এক পাগলার নাম


বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বোলিং আক্রমনের প্রাণ ভোমরা বলা হয় তাকে। মাঠে খেলেন নিজের শতভাগ উজাড় করে, জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসেন ক্রিকেট। বার বার বড় ধরনের ইনজুরিতে পড়েন, থাকতে হয় মাঠের বাইরে। আবার ফর্ম নিয়ে ফিরেও আসেন সগৌরবে। সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধরনের কয়েকটি অপারেশন হয় তার লিগামেন্টে। অনেকেই ভেবেছেন এবারই বুঝি ছেড়ে দেবেন ক্রিকেট। কিন্তু সবার আশঙকাকে ভুল প্রমাণিত করে তিনি ফিরে আসেন স্বরুপে। খেলার জন্য এভাবে জীবন বাজী তিনিইতো রাখতে পারেন। কারণ নাম যে তার মাশরাফি বিন মুর্তূজা।

মাশরাফি বিন মর্তুজা ৫ অক্টোবর ১৯৮৩, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা নড়াইল-এ জন্মগ্রহন করেন। ছোটবেলা থেকে মাশরাফি ছিলেন দুরন্ত। বাবা মায়ের আদর করে তাকে ডাকেন কৌশিক।লেখাপড়া ভালোভাবে মনোযোগ না দিয়ে বাবা গোলাম মর্তুজার বাধা ডিঙিয়ে ফুটবল, ব্যাডমিন্টন নিয়ে পড়ে থাকতেন। পাশাপাশি বাড়ির পাশে চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটাই ছিলো তার আসল কাজ। বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি করা, নারিকেল গাছে উঠে ডাব খাওয়া, নড়াইলের ফেরিঘাটে গিয়ে আড্ডা মারা ছিলো তার অন্যতম কাজ। এখনও সময় পেলে গ্রামের বাড়ি নড়াইলে গিয়ে বাইক নিয়ে চিত্রা ব্রিজের উপর আড্ডা দিয়ে সময় পার করেন মাশরাফি।

বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হোম সিরিজ। ডাক পেলেন কৌশিক।একই বছর ২৩শে নভেম্বর ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফির অভিষেক হয় ফাহিম মুনতাসির ও তুষার ইমরান এর সাথে।

তবে অনুর্ধ ১৯ দলের হয় খেলার সময় কৌশিকের গতিময় ও আক্রমনাত্বক বোলিংয়ের জন্য নজর কাড়েন তৎকালীন অস্থায়ী কোচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক ফাস্ট বোলার এন্ডি রবার্টসের।

২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ থেকে অধিনায়কের দায়িত্ব কাধেঁ ওঠে ম্যাশের। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, প্রথম ম্যাচেই মারাত্বক ইঞ্জুরীতে পড়েন তিনি। কিন্তু দেড় বছর পর আবার স্বরুপে ফিরে আসার ইঙ্গিত নিয়ে ইউরোপ সফরে যান দলের সাথে। ইংলান্ডকে প্রথম বারের মত বাংলাদেশ পরাজিত করে মাশরাফির অধিনায়কত্বে। কিন্তু এরপর আবার ইঞ্জুরীতে, যার কারনে খেলা হয়নি ঘরের মাঠের ২০১১ বিশ্বকাপেও!

টাকার জন্য খেলেননা মাশরাফি বরং দেশের জন্যই মরিয়া হয়ে খেলেন। এমনও দিন গেছে যে ব্যাথার ইনজেকশন নিয়েই মাঠে নেমে গেছেন শিশুসুলভ মাশরাফি।

একদিন মাশরাফি বলেছিলেন "জীবনে যে টাকা আমি আয় করেছি সে টাকা দিয়ে আমার ছেলেমেয়েরাও পর্যন্ত বসে খেতে পারবে, আমি দেশের জন্য ক্রিকেট খেলি, আমি আরো অনেক দিন ক্রিকেট খেলতে চাই দেশের স্বার্থে"

নিজ পরিবার নিয়ে জাতীয় দলের পারফেক্ট সেনাপতি বলেন, আমার বাসার প্রায় সব খাবারই নড়াইল থেকে আসে। চেষ্টা করি বাচ্চারা যেন স্বাস্থ্যকর খাবারটা খায়। পোশাক নিয়ে অত ভাবি না। একমাত্র ঈদ ছাড়া বাচ্চাদের জন্য দামি পোশাক কিনি না, তবে বাচ্চাদের খাবারের দিকে দৃষ্টি থাকে সবসময়।

সৌরভ গাঙ্গুলী বলেছিলেন "ইশ! আমাদের যদি একটি মাশরাফি থাকতো"।

তার দুপায়ের উপর দিয়ে গেছে কয়েকবার অপারেশন টেবিলের ছুরি। এরপরও তাকে কেউ রুখতে পারে নি। অপারেশনের পরও খেলে যাচ্ছেন বাংলাদেশের হয়ে। ইঞ্জুরিতে পড়ে অনেক বড় বড় খেলোয়ার অবসর নিয়েছে। ইঞ্জুরিতে পড়ার পর ব্রেটলি, শেন ভন, এন্ড্রু ফ্লিনটপের মত প্লেয়াররা ক্রিকেটে ফিরতে পারেন নি। কিন্তু মাশরাফি এরকম ইঞ্জুরি নিয়েও খেলে যাচ্ছেন। কারন তিনি মনে করেন বাংলাদেশের জন্য তার এই জীবন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা যেমন জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন ঠিক তেমনি তার জীবন দিয়ে খেলে বাংলাদেশকে জয় এনে দিতে চান।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারী এখনও মাশরাফি বিন মর্তুজা। এর আগ পর্যন্ত ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপে ১৩টি উইকেট নিয়ে সবার শীর্ষে ছিলেন রাজ্জাক। আফগানিস্তানের জাভেদ আহমাদি ও আসগর স্তানিকজাঈকে আউট করে রাজ্জাককে স্পর্শ করেন মাশরাফি।

মাশরাফি একজন মারকুটে ব্যাটসম্যানও। ভারতের বিপক্ষে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় তিনি পরপর চার বলে ছক্কা পেটান। সেই ওভার থেকে তিনি ২৬ রান সংগ্রহ করেন যা কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের জন্য এক ওভারে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।

বাংলাদেশ দলের বিশাল দায়িত্ব তাঁর কাঁধে, তাই ভেঙে পড়েন না তিনি। সবার আগে যে দেশ! সেই দেশের প্রেরণায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন প্রথম ম্যাচের আগুন-পরীক্ষায়। আর তাতে কী দারুণভাবেই না জ্বলে উঠলেন! মাঠে মাশরাফি জ্বলে উঠলে সেদিন প্রতিপক্ষের কী হয়, নিশ্চয় তা সবার জানা।

ব্যথা-যন্ত্রণা তো তাঁর নিত্যসঙ্গী। শুধু মনে নয়, ব্যথা ছিল শরীরেও। চোটের সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হননি, ভেঙে পড়েননি; সংশপ্তকের মতো উঠে দাঁড়িয়েছেন বারবার। নতুন উদ্যমে ফিরেছেন মাঠে। দেখিয়েছেন সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স। হাঁটুর চোটের কারণে নি-ক্যাপ পরে মাঠে নামতে হয়। নামেন। কিন্তু এতকিছুর পরও নিজেকে শতভাগ উজাড় করে দিতে এতটুকু কার্পণ্য করেন না তিনি। কারণ তিনি অপরাজেয়। তিনিই মাশরাফি বিন মুর্তূজা।

- সংগৃহিত।

No comments:

Post a Comment