Thursday, October 6, 2016

ঐতিহাসিক ছয় দফা, ১৯৬৬

৭ জুন-একটি স্মরণীয় দিন, একটি মহান দিবস। বাঙালির স্বাধিকারের সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য- পাকিস্তান হবে একটি Federal বা যুক্তরাষ্ট্র। ৬ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে যে হরতাল-আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা নির্যাতন, গ্রেফতার ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ লাভ করে। আর ছয় দফাকেই বাঙ্গালীর মুক্তির সনদ বলা হয়ে থাকে।


১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবিসমূহ 

প্রথম দফা : 
শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারী ধরনের। আইন পরিষদের (Legislatures) ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারনের সরাসরি ভোটে।

দ্বিতীয় দফা : 
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল মাত্র দু'টি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।

তৃতীয় দফা : 
মুদ্রা বা অর্থ-সমন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু'টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু'টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
(খ)বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবল মাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।

চতুর্থ দফা : 
রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলির সবরকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।

পঞ্চম দফা : 
বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন বাধা-নিষেধ থাকবে না।

(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বানিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং নিজেদের প্রয়োজনে বানিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।

ষষ্ঠ দফা : 
আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ রাষ্ট্র গুলিকে নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।



ছয় দফা দাবি উত্থাপণের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আইয়ুব খান এটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী দাবি হিসেবে আখ্যা দেন এবং বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু হিসেবে অভিহিত করেন। একইসাথে তিনি এই দাবিনামাকে কঠোরভাবে দমনের হুমকি দেন। কিন্তু এতে বিচলিত না হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আন্দোলন চালিয়ে যায় আওয়ামী লীগ।

বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে তিন মাসব্যাপী এক ব্যাপক গণসংযোগ কর্মসূচি গ্রহণ করেন যার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিটি কোণে পৌঁছে যায় ছয় দফা। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম তিন মাসে মোট আটবার গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। ছয় দফা কর্মসূচির সমর্থনে ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। এসময় পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে প্রায় ১৩ জন ব্যক্তি নিহত হন। আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু আইয়ুব প্রশাসনের এসকল পদক্ষেপে আন্দোলন দমে না গিয়ে উল্টো আরও জোরদার হয়ে ওঠে। ছয় দফার দাবিতে গণআন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে। এটি জনগণের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। ছাত্রসমাজও এই ছয় দফার সমর্থনে তাদের এগারো দফা দাবি পেশ করে। আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ; আইয়ুব শাসনের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠে বাঙালি সমাজ।

No comments:

Post a Comment