Thursday, October 6, 2016

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কিছু ব্যক্তির নাম, সময়কাল, ঘটনাপঞ্জি সময়ের বিচারে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে। এসবের মধ্যে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন ও তাতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধস নামানো বিজয় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম। এসব ঘটনা বা আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। আর আছেন এ দেশের কালজয়ী ছাত্রনেতারা। এসব সময়কাল বা ঘটনা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনে সহায়তা করেছে অথবা দেশকে তার স্বাধীনতার অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে গেছে। তবে বলতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার চূড়ান্ত লড়াইটা শুরু হয়েছিল ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে; আর সেই অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এই আন্দোলনের সূচনা করেছিল এই দেশের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো, যার নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগঠন বা ডাকসু। তাদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদে ছিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ (মেনন-মতিয়া)। পরবর্তীকালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সব কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তাতে যোগ দেয় মোনায়েম খানের পেটোয়া ছাত্রসংগঠন থেকে বের হয়ে আসা মাহবুবুল হক দোলন ও নাজিম কামরান চৌধুরীর নেতৃত্বে এনএসএফের একটি অংশ। উল্লেখ্য, এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন ছাত্রলীগের তোফায়েল আহমেদ (ইকবাল হল, পরবর্তীকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ও এনএসএফের নাজিম কামরান চৌধুরী (জিন্নাহ হল, পরবর্তীকালে সূর্য সেন হল)। বলে রাখা ভালো, সে সময় ডাকসুর প্রতিনিধি নির্বাচিত হতো পরোক্ষ ভোটে আর ছাত্রাবাসওয়ারি রোটেশনের ভিত্তিতে। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পুরোভাগে ছিলেন এ দেশের ছাত্রনেতারা, যাঁদের মধ্যে তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী ছাড়াও ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শামসুদ্দোহা, সাইফুদ্দীন আহমেদ মানিক, মোস্তাফা জামাল হায়দার, খালেদ মোহাম্মদ আলী, আবদুর রউফ, মাহবুব উল্লাহ, মাহবুবুল হক দোলন প্রমুখ (কারো নাম বাদ পড়লে তা অনিচ্ছাকৃত)। তবে বলে রাখা ভালো, সিরাজুল আলম খানের আচরণ এখনকার মতো তখনো ছিল বিভ্রান্তিমূলক ও রহস্যাবৃত। ছাত্রনেতারা গঠন করেছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাঁদের বাইরে ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে আর যে ছাত্রনেতারা যুক্ত থেকেছেন তাঁদের মধ্যে নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী অন্যতম। ওই মাপের ছাত্রনেতা বাংলাদেশে আর জন্মগ্রহণ করেননি। ভবিষ্যতে করবে তেমন আলামত এখন আর দেখা যায় না। কেমন ছিল সে সময়ের ছাত্রনেতৃত্ব তা বর্তমান সময়ের ছাত্রনেতারা কল্পনাও করতে পারবেন না। এই সময় বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা জেলে ছিলেন। একমাত্র উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতা, যিনি মুক্ত ছিলেন তিনি হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। তাঁকেও মাঝেমধ্যে আটক করা হতো। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছিল মূলত আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন হিসেবে, যেমনটি শুরুতে বলেছি। শুরুতে এই আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররাও শামিল ছিল। কিন্তু বাঙালি ছাত্রদের মতো তাদের বড় মাপের কোনো ছাত্রনেতা না থাকার কারণে তারা পুরো সময় এই আন্দোলনের সঙ্গে থাকতে পারেনি। সুতরাং ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ও পরবর্তীকালে গণ-অভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি ছিল এ দেশের প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলো।

১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয়। এর আগে ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য একবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলারা কখনো চাননি পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা একটি গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হোক। তাঁরা মনে করতেন, তা-ই যদি হয়, তাহলে তাঁরা জিন্নাহ সৃষ্ট পাকিস্তানে যে অবারিত ক্ষমতা ভোগ করছেন তা খর্ব হয়ে যাবে। পাকিস্তানের বর্তমান চরম দুর্দশার জন্য সে দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র সমানভাবে দায়ী। সেই যাত্রায় সংবিধান প্রণয়নের প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে দিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রই। অনেক চেষ্টার পর ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান প্রণয়ন করা হলো এবং এই সংবিধানের আওতায় ১৯৫৮ সালে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে তা নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু আবারও সেই সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ষড়যন্ত্র। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইসকান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূনকে বরখাস্ত করে পাকিস্তানের নতুন সংবিধান বাতিল করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন আর সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ঠিক ২০ দিনের মাথায় আইয়ুব খান ইসকান্দার মির্জাকে উত্খাত করে নিজে ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেন। সব সামরিক শাসকের মতো আইয়ুব খানও ক্ষমতা দখল করে ঘোষণা করেন, তিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করতে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন এবং স্বল্পতম সময়ে বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফিরে যাবেন। কিন্তু সেই আইয়ুব খানকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজন হয়েছিল। প্রাণ দিতে হয়েছিল কয়েক শ মানুষকে। ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর এটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার নিরাপত্তা বা স্বার্থের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন। এই উপলব্ধি থেকেই শেখ মুজিব (তখনো তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হননি) ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা উত্থাপন করেন। এই ছয় দফাকে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান ভাঙার পরিকল্পনা হিসেবে মূল্যায়ন করে এবং একপর্যায়ে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল শেখ মুজিব ও তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরা পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে ভারতের সহায়তায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাসে শেখ মুজিব ও তাঁর সতীর্থদের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়। বিচারটি রাষ্ট্রদ্রোহের এবং এর অবধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

যদিও আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেছিলেন দ্রুত ক্ষমতা ছাড়বেন বলে; কিন্তু নানা ছলচাতুরী করে তিনি তাঁর অগণতান্ত্রিক শাসন ১০ বছর পর্যন্ত প্রলম্বিত করে ১৯৬৮ সালে ‘উন্নয়নের এক দশক’ উদ্যাপন নামে এক তামাশার উৎসবের আয়োজন করেন। এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আইয়ুব খানের এই দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাটা সম্ভব হয়েছিল পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য, সন্দেহ ও সীমাহীন ক্ষমতা আর বৈষয়িক লোভ। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফা ঘোষণা করেন তখন তাঁকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগেও ভাঙন দেখা দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর লক্ষ্যে অবিচল থাকেন। আইয়ুব খান যখন তাঁর ‘দশক’ পালন করছেন তখন ঢাকা সেনানিবাসে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য একটি তামাশার মামলা আর তার বিচার চলছে। এই সময় মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দানা বাঁধা শ্রমিক-ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পুরোভাগে চলে আসেন। উল্লেখ্য, এই সময় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা হয় জেলে অথবা গা বাঁচিয়ে চলছেন। পূর্ব বাংলা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানেও আইয়ুব খানবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালের ১৩ নভেম্বর আইয়ুব খান পিপলস পার্টির প্রধান ও তাঁর এককালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গ্রেপ্তার করেন। দ্রুততম সময়ে অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদেরও তিনি কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এই সময় আইয়ুব খান বস্তুতপক্ষে নিজের জন্য নিজের অজান্তেই একটি ভয়াবহ আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করছিলেন। এই সময় আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন অবসানকল্পে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট বিভিন্ন কর্মসূচি দিতে থাকে এবং দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি উত্থাপন করে। তবে সব কিছু ছাড়িয়ে যায় ১৯৬৯ সালে ছাত্রদের ঘোষিত ১১ দফা কর্মসূচি। এত কিছুর মধ্যেও আইয়ুব খানের আচরণ ছিল অনেকটা বেপরোয়া। কারণ তাঁর পেছনে ছিল পাকিস্তানের সুবিধাভোগী সামরিক-বেসামরিক আমলা আর যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সমর্থন। ১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর আইয়ুব খান তাঁর গঠিত কনভেনশন মুসলিম লীগের এক কর্মী সম্মেলনে বলেন, ‘বিক্ষোভ করে সরকারকে টলানো যাবে না।’ তিনি সব সময় মনে করতেন, ক্ষমতা দখল করে তিনি পাকিস্তানে একটি বিপ্লব সাধন করেছেন। ১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দুটি সভায় মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে, যাতে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছাড়াও অন্তর্ভুক্ত করা হয় ১. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ২. আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ সব রাজনীতিবিদের মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেনি, একই সঙ্গে তারা রাজপথের আন্দোলনও বেগবান করে। পেছন ফিরে তাকালে আজ মনে হয় ১৯৬৯ সালে বাংলার দামাল ছাত্ররা পাকিস্তানের রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে শুধু এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন তা-ই নয়, বরং ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে তাঁদের সেই চ্যালেঞ্জ তাঁরা বাস্তবায়ন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন ছিল জিন্নাহর পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক আর ১৯৭০ সালের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই কফিনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা (মেনন) আসাদুজ্জামান আসাদের মৃত্যু। এদিন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সকাল ১১টা নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ছাত্রদের এক সমাবেশের পর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে এক মিছিল বের হয়। মিছিলটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে চানখাঁরপুল পৌঁছলে পুলিশ আর ইপিআর (তত্কালীন সীমান্ত রক্ষীবাহিনী) বিনা উসকানিতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ ও টিয়ার গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে। আহত হন অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন আসাদুজ্জামান আসাদ। এই এক রাজপথের সৈনিক আসাদের মৃত্যু ছাত্র-জনতার রাজপথের আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তর করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সারা দেশে দিনের পর দিন হরতাল পালিত হতে থাকে। অন্যদিকে সরকার ১৪৪ ধারা, কারফিউ, গণগ্রেপ্তারসহ দমন-পীড়নের মাধ্যমে দেশের জনগণের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। রাস্তায় নামানো হয় সেনাবাহিনী। ২৪ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান মল্লিক পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। রাতে কারফিউ ভেঙে ছাত্র-জনতা রাজপথে মিছিল বের করলে সেনাবাহিনী আর ইপিআর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে অসংখ্য মানুষকে হয় হত্যা করে অথবা আহত করে। তেজগাঁও এলাকায় শিশুকে দুগ্ধপানরত অবস্থায় নিহত হন আনোয়ারা বেগম নামের এক মা। টঙ্গী আর আদমজীতে নিহত বা আহত হন অসংখ্য শ্রমিক ও খেটেখাওয়া মানুষ। এই আন্দোলনের একটি বড় দিক ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে জনগণ পুলিশ হোক বা সেনাবাহিনী, তাদের কাছ থেকে নিহত বা আহত ব্যক্তিদের ছিনিয়ে নিত এবং প্রায় সময় পল্টন ময়দানে তাঁদের জানাজা হতো এবং তাতে প্রায়ই মওলানা ভাসানী ইমামতি করতেন। একপর্যায়ে বিক্ষোভরত জনতা প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তানের প্রকাশনা ভবন ও প্রেসে অগ্নিসংযোগ করে। ‘দৈনিক পাকিস্তান’ সরকারের পত্রিকা হলেও মাঝেমধ্যে তারা চেষ্টা করত জনগণের পক্ষে কথা বলতে। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে সমর্থন জুগিয়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ ও অধুনালুপ্ত দৈনিক আজাদ। আইয়ুব খানের আস্থাভাজন হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভারের ভূমিকা ছিল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো।

যে আন্দোলন এ দেশের ছাত্ররা আইয়ুববিরোধী আন্দোলন হিসেবে শুরু করেছিলেন, সেই আন্দোলনই আসাদের মৃত্যুর পর ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয়। এই দিনই মতিউর শহীদ হয়েছিলেন। এই আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ে। আইয়ুব খান হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন দেশের শাসনক্ষমতা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হককে ঢাকা সেনানিবাসের কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যার প্রতিবাদে উন্মত্ত জনতা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান বিচারপতি এস এ রহমানের সরকারি বাসভবন (বর্তমান বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে) আর সরকারি কৌঁসুলিদের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করে তা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। বিচারপতি এস এ রহমান কোনো রকমে দেয়াল টপকে জীবন রক্ষা করেন। অন্যরাও একইভাবে পালিয়ে জীবন বাঁচান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সামসুজ্জোহা। ২০ জানুয়ারির পর পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীবাহিনী আর সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রায় ৩০০ মানুষ প্রাণ দেন, যার অধিকাংশই ছিলেন পূর্ব বাংলার। এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে টঙ্গী ও আদমজী এলাকার শ্রমিকরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এবং অকাতরে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। ছাত্র-জনতার তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে মামলায় অভিযুক্ত সব বন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন।

শেষ রক্ষা হিসেবে আইয়ুব খান রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে চলমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন, যা সংকট নিরসনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানের বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লে আইয়ুব খান ২৫ মার্চ পাকিস্তানের শাসনভার দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে তুলে দেন। ইয়াহিয়া খান বস্তুতপক্ষে জিন্নাহর পাকিস্তানের জানাজায় ইমামতি করেন। পেছন ফিরে তাকালে এখন এটি কল্পনা করাও অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে কেমন ছিল সেই অগ্নিঝরা দিনগুলো। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের বা গণ-অভ্যুত্থানের মূল নায়ক ছিলেন এ দেশের ছাত্র-জনতা আর মেহনতি মানুষ। নেতৃত্বে ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সামনে থেকে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছেন আজকের তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ। সেই আন্দোলনের রাজপথের একজন সৈনিক হিসেবে এখনো গর্ব বোধ করি। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সব শহীদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।


লেখক : আব্দুল মান্নান।
বিশ্লেষক ও গবেষক

No comments:

Post a Comment