প্রথমেই শিক্ষা নিয়ে শুরু করা যাক। শিক্ষাকে আমরা বিদ্যা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান অনেক নামেই অভিহিত করতে পারি।দেশ ও সমাজ উন্নয়নের মূল ভিত্তি শিক্ষা৷ সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক নানা কারণে এ দেশের দরিদ্র মানুষ যেমন বঞ্চিত হয়েছে তেমনি সর্বস্তরে ব্যাপক সংখ্যক নারীও এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত৷ পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় গেঁাড়ামি, সামাজিক কুসংস্কার, নিপীড়ন ও বৈষম্যর বেড়াজালে সর্বদা নারীকে ঘিরে রাখা হয়েছে৷ নারী শিক্ষাকে শুধু পরিবারের মঙ্গল, শিশু যত্নের ও ঘরকন্নার কাজে সীমাবদ্ধ রেখে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক জাতীয় উন্নয়নে নিষ্ক্রিয় রাখার পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রবণতা দূর করতে হবে৷ ১ঌ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীও অসামান্য অবদান রেখেছে৷ সস্বাধীনতার পর থেকে নারী আত্মনির্ভরশীল, জাতীয় উত্পাদনে অংশগ্রহণ, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেতন হয়ে ওঠে৷ তাই নারীর সার্বিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং সেই আলোকে নারী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷
নারী শিক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নারীকে সচেতন ও প্রত্যয়ী করা, সম-অধিকারের অনুকূলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গী প্রখর করা, সকল পর্যায়ে দেশ পরিচালনায় অংশ গ্রহণে নারীকে উদ্বৃদ্ধ ও দক্ষ করা, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ও দারিদ্র বিমোচনে নারীর অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করা, আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে সহায়তা করা, সুন্দর ও স্বচ্ছন্দ্যময় পরিবার গঠনে উত্সাহিত করা এবং যৌতুৃক ও নারী নির্যাতন রোধ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে পারেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি ও আত্মপ্রত্যয় নারীর মধ্যে সৃষ্টি করা৷
বর্তমানে নারী শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নের নামে অনেক উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে পাশ্চাত্যের অনুকরণে। কত নীতিমালা রচিত হচ্ছে ও হবে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও নারী উন্নয়ন নীতি মালার নামে একটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেছিল, কিন্তু দেশের ধর্মপ্রিয় মুসলমানদের প্রতিবাদের মুখে তারা ক্ষান্ত হয়। ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি মাঝে মাঝে শয়তানের খপ্পরে পড়ে শাসক শ্রেণী তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালায়। নীতিমালার একটা ধারা হল : জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ১৫ পৃষ্ঠার ৯-১৩ উপ-ধারায় নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, "নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে জরুরী বিষয়াদি যথা-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবন-ব্যাপী শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা, তথ্য, উপার্জনের সুযোগ, সম্পদ, ঋণ, প্রযুক্তি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর সমান সুযোগ এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার ও সেই লক্ষ্যে নতুন আইন প্রণয়ন করা।" যেহেতু এখানে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, তাতেই সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার জন্য তো শুধু নারীকে আলাদা গুরুত্ব দেব কেন? সংবিধানই তো বলে সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করতে। এভাবে আইন প্রণয়ন না করে সবার জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করলেই সুন্দর ব্যবস্থা যায়। কুচক্রীদের কুমতলব আছে, তারা ধর্মীয় ভাবসদ্ভাবে আঘাত করে ধর্মীয় উম্মাদনা তৈরী করতে চায়। যাতে ইসলামকে একটি বিশৃংখল ধর্ম বলে প্রচারণা চালাতে পারে। আমাদের নীতি নির্ধারকদের মনে রাখা উচিত, দেশের জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধকেই শিক্ষানীতি তৈরী করার সময় প্রাধান্য দিতে হবে। নৈতিকতাহীন শিক্ষা, পরস্পর বিরোধী শিক্ষা, সহশিক্ষা, সেশনজট মুক্ত শিক্ষা পরিহার করে একটি জীবন ও জগতের পরিচ্ছন্ন ধারণানুযায়ী উৎপাদনশীল ও কর্মমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যা প্রযোজ্য হতে পারে।
এটা অবধারিত সত্য যে, শিক্ষাক্ষেত্রের নারীর কাক্মিখত অগ্রগতি না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কখনই সম্ভব হবে না। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে সকল স্তরের শিক্ষায় জেন্ডার বৈষম্য হ্রাস করার কথাও বলা হয়েছে।
নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপের জন্য আন্তর্জাতিক দলিল সিডো সনদে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে নারীর শিক্ষা অর্জনের সমাধিকারের প্রতি। সিডো সনদের ধারা ১০-এ শিক্ষাক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নারীর শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, সকল শিশুর জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য খাদ্য কর্মসূচি রয়েছে। পৌরসভার বাইরে বিনাবেতনে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ আর মহানগরের বাইরে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য উপবৃত্তির সুযোগ রয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে।
শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে জাতীয় নারী প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন একাডেমি পুনর্গঠন এবং প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপন করা হয়েছে। বেগম রোকেয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, বেগম শহীদ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব মহিলা প্রশিক্ষণ একাডেমি এবং মহিলা কৃষি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য কারিগরি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া ছাত্রছাত্রীদের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে। বয়স্ক নারী শিক্ষা কার্যক্রমও চালু করা হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে আরও অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
নারী শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে বেসরকারি পর্যায়েও রয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। রয়েছে মেয়েদের জন্য বিভিন্ন সংস্থার বিশেষ বৃত্তি, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, আয়মূলক প্রশিক্ষণের সঙ্গে শিক্ষ, নারীদের জন্য বিশেষ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন উদ্যোগে।
সন্দেহ নেই, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নারী শিক্ষার হার আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু তারপরও আর্থ-সামাজিক বেশকিছু সমস্যা রয়েগেছে যা নারী শিক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নারীর উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আর্থ-সামাজিক বাঁধাগুলো দূর করা প্রয়োজন। সর্বোপরি সমাজে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এবং নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার জন্য নারীর উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করার বিকল্প কোন পথ নেই।
- সংগৃহিত।
No comments:
Post a Comment