Thursday, October 6, 2016

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাস

উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলা এবং বাঙ্গালীর ছয় দশকের সংগ্রাম সপ্ন এবং সাহসের সারথী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বাংলাদেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের গর্বিত অংশিদার এই ছাত্র সংগঠনটি। জাতির ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ে রয়েছে ছাত্রলীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকা। বাঙ্গালী জাতি হিসেবে জন্ম গ্রহনের আতুর ঘর থেকে শুরু করে আজ অবধি স্বাধীনতা, সংগ্রাম আর শিক্ষার নিশ্চয়তার ছাত্রসমাজের তথা দেশবাসীর জন্য অতন্ত প্রহরী বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। 

বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময় সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কলকাতা ইসলামীয়া কলেজের ছাত্র। তিনি ছিলেন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক। বৃটিশ উপনিবেশ থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের পর বাঙ্গালীরা নতুন ভাবে শোষনের যাতাকলে পড়ে। যাকে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ''এক শকুনির হাত থেকে অন্য শকুনির হাত বদল মাত্র ''। তাই নতুন রাষ্ট্র পাকিস্থানের সরকার প্রথমে আঘাত হানে আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার উপর। বঙ্গবন্ধু তখনই অনুভব করলেন শোষনের কালো দাঁত ভাঙ্গার একমাত্র হাতিয়ার ছাত্র সমাজ। তাই তৎকালিন পাকিস্থান সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া উর্দূ ভাষার বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন প্রতিরোধ তৈরির জন্য ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তৎকালিন প্রজ্ঞা ও দূরদর্শীতা সম্পন্ন ছাত্র নেতা বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন 'পাকিস্থান ছাত্রলীগ'।বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রলীগের যাত্রা শুরু। প্রথমে এর নাম ছিলো 'পাকিস্থান ছাত্রলীগ'। সংগঠনটির প্রথম আহবায়ক ছিলেন নাঈমউদ্দিন আহমেদ। ছাত্রলীগ সাংগঠনিক ভাবে কার্যক্রম শুরু করলে এর সভাপতি মনোনিত হন দবিরুল ইসলাম ও সাধারন সম্পাদক মনোনিত হন খালেক নেওয়াজ খান। ৬৮বছর পর আজ এই বৃহৎ, ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটির গৌরবের পতাকা সভাপতি এইচ সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারন সম্পাদক এস.এম জাকির হোসেন এর হাতে। 

ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার এক বছর পর ১৯৪৯ সালে এই ছাত্র সংগঠনটির হাত ধরেই তৎকালীন পাকিস্থানের প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে 'আওয়ামী মুসলিম লীগে'র। যা পরে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে এ দেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়। তৎকালিন পাকিস্থান সরকারের শাসন শোষন আর বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জন্মের পর থেকে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনটির নেতাকর্মীরা জাতীয় রাজনীতিতেও নেতৃত্ব দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। জাতির পিতা বঙ্গবল্পব্দু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী ৭১'র মহান মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে জীবন উৎসর্গ করেছেন। রনাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন ছাত্রলীগের ১৭ হাজার সাহসী বীর সৈনিক। বর্তমান জাতীয় রাজনীতির অনেক শীর্ষ নেতার রাজনীতিতে হাতেখড়িও ছাত্রলীগ থেকেই। ১৯৪৮ সালেই মাতৃভাষার পক্ষে ছাত্রলীগ আপোষহীন অবস্থান তৈরি করে। ১১ মার্চ ছাত্রলীগ উর্দুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ধর্মঘট পালন করে। ওই ধর্মঘটের পিকেটিং থেকেই গ্রেফতার হন রাজনীতির মাঠের জ্বলজ্বল করে থাকা তারকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের মেধাবী ছাত্র, বাঙ্গালীর রাজনীতির রাখাল রাজা, ছাত্রনেতা শেখ মুজিব ও তার সহযোগীরা। ছাত্রলীগই প্রথম বাংলা ভাষার জন্য ১০ দফা দাবিনামা পেশ করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ও আন্দোলন জোরালো করার ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অবিস্মরনীয়। 

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় নিশান উড়ানোর নেপথ্যের কারিগরও ছিলো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ১৯৫৬ সালের বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়, ৫৭'র শিক্ষক ধর্মঘট এবং ৬২'র শিক্ষা আন্দোলনের পালে সমিরন প্রবাহ করে ছাত্রলীগ। ১৯৬৬ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারী থেকে ২০ ফেব্রুয়ারী ছাত্রলীগের নেতৃত্বে প্রচলন হয় বাংলা সপ্তাহ। বাঙ্গালীর মুক্তির ছয় দফা হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক 'ছয় দফা' আন্দোলনে রাজপথের প্রথম সারিতে অবস্থান ছিল ছাত্রলীগের। এসময় নিজেদের ১১ দফার মাধ্যমে ছাত্রসমাজের রক্তে প্রবাহ সঞ্চার করে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নেতৃত্বেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছাত্র-গণ আন্দোলন থেকে গণঅভূত্থানে রূপ নেয়। গণজাগরনের ৭০'র নির্বাচনে মুক্তির সনদ ছয় দফাকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এক দফার গণভোটে রূপ দেয়। এরপর ৭১'র ত্রিশ লাখ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলার আকাশে যে রক্ত স্নাত লাল সূর্যোদয় হয় তাতে পরিসংখ্যানের হিসেবে বিশ্বের বৃহৎ ও সংগ্রামী সংগঠন ছাত্রলীগের আত্মত্যাগী নেতাকর্মীদের সংখ্যা ছিল ১৭০০০ (সতের হাজার)। 

১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ কালপূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ গঠনের সংগ্রাম ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিলো অগ্রগন্য। ১৯৭৫ সারে জাতির পিতা ও তার পরিবারে সদস্যদের নির্মম ভাবে হত্যার পর বাঙ্গালীর জাতির ভাগ্যকালে আবার কালো গ্রাস করে নেয়। স্বৈরশাসক মেজর জিয়া ও তৎপরবর্তী রাজনীতির মাঠে সামরিক চাষবাসের তিক্ত ফসল বাঙ্গালীদের অতিষ্ঠ করে তোলে। যা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে রাজপথে রক্ত দিতে হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৮৩ সালে শিক্ষা আন্দোলন ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের দশ দফা তৈরিতে নেতৃত্ব দেয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। শিক্ষার অধিকার প্রসারে শামসুল হক ও অধ্যাপক কবীর চৌধুরির কমিশনে রিপোর্ট তৈরিতে ছাত্রসমাজের পক্ষে জোড়ালো অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। 

এরপর একটি সফল গণঅভূত্থান পরবর্তী নির্বাচনে দীর্ঘ একুশ বছর পর সরকার গঠন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ছাত্রলীগ মহিয়সী নেত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক নির্দেশ প্রতিপালন করেছে। ১৯৯৮ সালের বন্যা মোকাবেলায় কিছু ব্যক্তির দুর্ভিক্ষের আশংকাকে ভুল প্রমান করেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তিন শিফটে রুটি তৈরি করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। তৈরী করেছে দুর্যোগপূর্ন এলাকার মানুষের জন্য খাবার স্যালাইন। দুসময়ে দুর্গত এলাকায় রুটি ও স্যালাইন বিতরন করে মানুষের জীবন রক্ষা করেছে ছাত্রলীগ কর্মীরা। যার মাধ্যমে হতাশা ও প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তিদের আশংকার জবাব দিয়েছে ছাত্রলীগ। ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল আপোসহীন। নিরক্ষরতা মুক্ত, পোলিও মুক্ত বাংলাদেশ বির্নিমান ও বৃক্ষরোপনের মধ্যেমে বিশ্বের উষ্ণায়ন কমাতে প্রতিটি জেলায় জেলায় কাজ করেছে ছাত্রলীগ। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী বিএনপি জামায়াত জোটের সহিংসতা এবং দেশব্যাপী সাংগঠনিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ প্রতিরোধ রচনা করেছে। পাক আত্মনির্ভর বিএনপি জামায়াত জোটের হাতে এদেশের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে জোড়ালো প্রতিবাদ করেছে ছাত্রলীগ। ২০০১ সালের পর বিএনপি জামায়াত জোটের প্রত্যক্ষ মদদে শান্তির এই ভূখন্ডে জঙ্গীবাদরে উত্থান হলে ছাত্রলীগ তার বিরুদ্ধে রাজপথে কঠোর প্রতিবাদ রচনা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অধ্যাপক ড.হুমায়ুন আজাদের উপর মৌলবাদি হামলার প্রতিবাদেও রাজপথে ছিলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। এরপর ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাষ্ট্রীয় মদদে সর্বকালের সবচেয়ে পৈচাশিক গ্রেনেট হামলার মাধ্যমে বাংলার মানুষের চির আস্থার ঠিকানা আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার জীবন নাশের হামালা জোড়ালো প্রতিবাদ জানায় ছাত্রলীগ। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই আমাদের প্রিয় নেত্রী বাংলার দু:খি মানুষের একমাত্র আস্থার ঠিকানা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে সামরিক কায়দায় আটকের পর সামরিক বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রাজপথে প্রথম প্রতিবাদ রচনা করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বিতর্কীত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে গ্রেফতার হয়ে উনিশ মাস কারাবরন করেন ছাত্রলীগের তৎকালিন সাধারন সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রটন সহ অনেক জেষ্ঠ্য নেতা । তবুও প্রাণাধিক প্রিয় নেত্রীর মুক্তির আন্দোলন থেকে ছাত্রলীগকে পশ্চাতে হঠাতে পারেনি শাসক শ্রেনী। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রধর্মঘট পালন করে ছাত্রলীগ প্রিয় নেত্রীর মুক্তির অদম্য আন্দোলন রচনা করে। এরপর ২০০৮ সালের ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের বিজয় নিশ্চিত করতে নিরলস ভাবে কাজ করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিটি মুজিব সৈনিক। এরপর পর বাংলাদেশের সরকার গঠন করে আওয়ামীলীগের নেতৃ্ত্বাধীন মহাজোট। দেশে জননেত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বে শুরু হয় দিন বদলের সরকারের পথ চলা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনের শর্ত অনুযায়ী সাংগঠনিক সভানেত্রীর পদ থেকে হারাতে হয় আমাদের প্রিয় নেত্রীকে।

২০০১ সাল পরবর্তী সময়ে একাত্তরের পরাজিত শক্তি, সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর হাতে দেশ জিম্মি থাকার প্রেক্ষাপটে ২০০৫ সালের ৭ ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করেছিল সাতটি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (জাসদ), বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় ছাত্র ঐক্য, বাংলাদেশ ছাত্র সমিতি ও জাতীয় ছাত্র ফোরাম সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। অতীতে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের বর্তমান সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস.এম জাকির হোসেনের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, মহানগর, বিশ্ববিদ্যালয় ও থানায় যুদ্ধাপরাধমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।  বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সমাপ্ত করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী রাজপথে সাহসী ভূমিকা রাখছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে  এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অগণিত নেতাকর্মীকে শহীদ হতে হয়েছে।

No comments:

Post a Comment